ধ্রুবকন্ঠ | Dhruba Kantho

ভোরের অপেক্ষায়...


শেখ শুভ
শেখ শুভ
প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫ | প্রিন্ট সংস্করণ | ফটো কার্ড

ভোরের অপেক্ষায়...
ছবি: শেখ শুভ

এক.

কফি হাতে সোমা বারান্দায় এসে দেখে মুহিত নিচের টং দোকানে বসে সিগারেট ফুকছে। কটকটে হলুদ রঙের গেঞ্জির সাথে জিন্সের প্যান্ট। পেছনে ঘাড়ের কাছে ফুটো হওয়া এই গেঞ্জিটাও পরে আছে আজকে সাত দিন ধরে। সোমা অবশ্য কখনো ওকে প্যান্টটি বদলাতে দেখেনি।

সোমার ধারণা, গত এক বছরে এই প্যান্ট ওর কোমর থেকে কেউ নামাতে পারেনি। ঢাকার চটচটে গরমে এক কাপড়ে কেউ সাতদিন থাকতে পারে, এটা মুহিতকে না দেখলে সোমা বিশ্বাসই করতে পারতো না।

গত কয়েকদিন লাপাত্তা ছিল মুহিত। ফোনেও পাওয়া যায়নি।

সোশ্যাল মিডিয়াতেও ইন্যাক্টিভ ছিল। এমন খুব একটা হয়না। ফোন না ধরা কিংবা ম্যাসেজের রিপ্লাই না করা ওর স্বভাব কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াতে অনুপস্থিত মানে সিরিয়াস কিছু।

এত সকালে টঙের দোকানে ওকে দেখে সোমার রাগ করা উচিত।

কিন্তু কেন যেন খুব ভালো লাগছে সোমার। দোকানের বেঞ্চিতে মুহিতের বসার জায়গাটা ফিক্সড। ওখানে বসলে সোমাদের বারান্দা থেকে শুধু ওর মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল পিঠ দেখা যায়। গত দুই বছরে সোমা ওকে অন্য কোথাও বসতে দেখেনি। সাধারণত মুহিত ওর বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সন্ধ্যার পরে আড্ডা দিতে বসে ওই দোকানে।আড্ডা চলে গভীর রাত পর্যন্ত। সন্ধ্যার দিকে পনের বিশজন থাকলেও রাতের দিকে একটু ফাঁকা হয়ে আসে। তখন ওরা পাঁচ/ছয় জনই থাকে। কোথায় ছিল জানতে মুহিতকে কল দিলো সোমা।
-
কোথায় ছিলে?
-
গর্তে। হাসতে হাসতে বললো মুহিত।
একটা কল দিতে পারতে?
-
উপায় ছিল না। পারলে দিতাম। তুমি কেমন আছো?
-
ভালো। তুমি?
-
আমি ভালো নেই সোমা? কিভাবে ভালো থাকি বোলো? স্বাধীন দেশে মুক্ত বাতাসে কথা বলার ক্ষমতা এই জাতি হারিয়ে ফেলছে। শোষণের এক হাত মুখের সাথে নাকও চেপে ধরে আছে। এভাবে বেঁচে থাকা যায়?
-
তুমি একা কি করতে পারবে?
-
আমি একা নই সোমা? যাই হোক খুব বেশি প্রয়োজন না হলে আমাকে ফোন করো না। দরকার হলে আমিই তোমার সাথে যোগাযোগ করবো।
মুহিত ফোন রাখতেই শিখাকে কল করলো সোমা। আজকে ভার্সিটিতে যাবে কিনা জানতে?

ইদানিং প্রায়ই ছোট খাটো আন্দোলন হচ্ছে ভার্সিটিতে, কোটা সিস্টেম নিয়ে। যদিও সরকার দলীয় ছাত্রনেতারা কাউকে তেমন দাঁড়াতে দিচ্ছে না, তারপরেও প্রায় প্রতিদিনই মিছিল মিটিং হচ্ছে। হল থেকে ছাত্রীরাও যোগে দিচ্ছে প্রতিবাদ মিছিলে।
হ্যা সোমা বল? ফোন রিসিভ করে শিখা বলো।
-
আজ কি ভার্সিটিতে যাবি?
-
যাবো। আজকে নিলয় স্যারের ক্লাস আছে। তুই চলে যা। দশটায় ক্লাস।
নারে আজকে আসতে পারবো না। এই জন্যই তোকে ফোন দিলাম। তুই নোটগুলো নিয়ে নিস।
ঠিক আছে, কিন্তু আসবি না কেন? তোর হিরো কি ব্যাক টু দা টঙের দোকান?'
-
হুমম!
-
নিশ্চয় ফুটোওয়ালা হলুদ গেঞ্জি পরে বসে আছে?
-
হ্যা।
-
আর তুই কি করছিস? পেছন থেকে ওর চওড়া কাঁধ ঝাঁকড়া চুলের সাথে বিড়ি ফুঁকা দেখছিস? তোকে নিয়ে আর পারি না।
-
কি করবো তাহলে?
-
কি করবি মানে? তুই কি ভাবছিস যে মুহিত ভাই তোকে ভর সন্ধ্যায় বেড়িবাঁধে চাঁদ দেখাতে নিয়ে যাবে? নাকি ভ্যালেনটাইন ডে'তে হীরের আংটি দিয়ে চমকে দিবে? এখনো সময় আছে। নিজেই নিজেকে উনার কাছে সঁপে দে। কয়েকদিনের যে শারীরিক সুখ পাবি, সেটা দিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিবি। হে হে হে...
-
কি যা তা বলছিস। তোর মুখে কিছুই আটকায় না।
-
যা তা বলছি না বন্ধু। বাস্তব কথা বলছি। তুই ভুল মানুষের প্রেমে পড়েছিস। মুহিত ভাই ঘর-সংসার করা টাইপ ছেলে না। মুহিত ভাইয়েরা কালে ভান্দ্রে দুই একটা জন্মায়। বারুদের মতো জ্বলে উঠে। তারপর একদিন টুপ করে পুলিশের গুলি খেয়ে মরে যায়। যাওয়ার আগে আশেপাশের কিছু ছেলে পেলের মাথা নষ্ট করে দিয়ে যায়। তোর মতো দুই একটা মেয়ে দুনিয়াতে রেখে যায়, যারা না পাওয়ার বেদনা নিয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দেয়। এই হচ্ছে ধ্রুব সত্য। রাখছি। আমার খেলা শুরু হয়ে যাচ্ছে।

শিখাটা এমনই। ওর মুখে কিছুই আটকায় না। বাঙালি সুন্দরী বলতে যা বোঝায় সেরকম না হলেও, ওকে অনায়াসে সুশ্রী বলা যায়। ওর দৈহিক গড়ন বেশ পেটানো। একফোঁটা মেদ নেই শরীরে। নিয়মিত টেনিস খেলে ঢাকা ক্লাবের পাশের কোর্টে। ওর বাবা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেছুর রহমান ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ওর বাবা মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে কয়েক বছর আগে। ওর মা আর বড় ভাই এখন অস্ট্রেলিয়াতে সেটেলড। রয়ে গেছে বাবার সাথে। ধানমন্ডিতে বেশ সুন্দর বাড়ি ওদের। মায়ের সাথে না যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে 'কিছুটা সময় বাবার সাথে থেকে চলে যাবো মায়ের কাছে। সেখান থেকে বেরিয়ে পড়বো স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে।' শিখার স্বপ্ন দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানো এবং পৃথিবীর সর্বোচ্চ সাতটি পর্বত শৃঙ্গ জয় করা। গতবছর থেকে এইজন্যই ট্রেকিং এর ট্রেনিং নিচ্ছে।

শিখা দুরন্ত। প্রাণশক্তিতে ভরপুর। ভার্সিটিতে খুব পপুলার। কেউ শিখার কাছে হেল্প চেয়ে পায়নি, এমন কখনো হয় নি। ধুপধাপ যখন যা খুশি করে বেড়াচ্ছে। গত বছর ডিপার্টমেন্ট এর পিকনিকে গিয়ে ছেলেদের সাথে জোর করে ফুটবল খেলছে। টানা ৩০ মিনিট খেলে একটা গোল করে তবে

মাঠ ছেড়েছে। একবার ভার্সিটির এক বড়ভাই মাস তিনেক ওর পেছনে ঘুরে খুব সাহস করে বলে ফেলেছিলো, শিখা আমি তোমাকে ভালোবাসি।
সেই প্রেম সপ্তাহখানেক টিকেছিল। কারণ, শিখা তাকে হোটেলে নিয়ে গিয়ে বলেছিলো আসেন প্রেমের শুরক আগে আপনার পারফরমেন্সটা টেস্ট করে ফেলি। সেই লোক পালিয়েছিল্যে তখনি। বুঝতে পেরেছিলো এই মেয়ের সাথে আর যাইহোক প্রেম করা চলে না।

নিলয় স্যারের ব্যাপারটাই ধরা যাক। উনি ভাসিটিতে নতুন জয়েন করেছেন। ভদ্রলোক কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে এসেছেন। বেশ ভালোই পড়ান। স্টুডেন্টরাও উনাকে পচ্ছন্দ করেন। প্রমিত বাংলায় কথা বলেন। উনার ওয়াইফ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। মজার বিষয় হলো উনি যে উনার বৌয়ের ভয়ে সবসময় তটস্থ থাকেন এটা ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে শিখার কারণে। স্যার একবার ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করায় শিখা তাতে লাভরিঅ্যাক্ট দিয়েছিলো। পরিণতি, সন্ধ্যায় স্যার এর কল এবং সনির্বন্ধ অনুরোধ, শিখা যেন আভা ম্যাডামকে (নিলয় স্যারের ওয়াইফ) একটু বুঝিয়ে বলে যে স্যারের সাথে শিখার কোনো লটর পটর নাই। শিয়া কি বলেছিলো জানি না, তবে শিখার প্রতি ম্যাডামের অগ্নিদৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায় সেই আলাপন খুব একটা সুখকর ছিল না। এরপর থেকে স্যার ফেইসবুক ফুল-পাখি কিংবা সবজির ছবি দিয়ে জীবন কত সুন্দর কিংবা তপ্ত দুপুরে মিষ্টি হাওয় টাইপের কোনো পোস্ট দিলেই ওরা বুঝতে পারে আজকে ঘটনা যারাপ। শিযার ধারণা। আসলে ধারণা না. দৃঢ় বিশ্বাস, ম্যাডাম স্যার কে নিয়মিত মারধর করেন। স্যার সর্বক্ষণ এর থেকে পরিত্রানের উপায় খুঁজে বেড়ান এবং সুযোগ পেলেই যেকোনো সময় তার মেয়েকে নিয়ে বিদেশে চলে যাবেন। তাদের তিন জনেরই কানাডার সিটিজেনশিপ নেয়া আছে। এছাড়া ক্লাসের অনেকেই মনে করে স্যার এর তুলনায় ম্যাডাম এর গোফের রেখাটা একটু বেশি পরু।

দুই

দুপুরের দিকে একটু ঘুমিয়েছিলো সোমা। ঘুম থেকে উঠে দেখে তার ফুফা ড্রয়িং রুমে বসে তার বাবার সাথে গল্প করছে। আবুল হায়াৎ পাটোয়ারী
সোমার আপন ফুফা নন। উনি সোমার বাবার ফুফাতো বোনের হাসব্যান্ড। বিস্তর সম্পত্তির মালিক। বিজি প্রেসের একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হয়ে উনি যে পরিমান প্রপাটি করেছেন তা এক বিস্ময়। মোহাম্মদপুরে উনাদের তিনটি ছয়তলা বাড়ি। যার একটিতে সোমারা ভাড়া ছিল প্রায় চার বছর। জিন মাসের ভাড়া বাকি থাকার কারণে এক সন্ধ্যায় এই ফুফা সোমাদের হাসিমুখে বাসা থেকে বের করে দেন। বাবা মা ছোট ভাই সহ সোমাদের ওই রাতটি বাসার বাইরেই কাটাতে হয়েছিল। ভদ্রলোকের আগমনের হেতু বোধহয় মেয়ের বিয়ের দাওয়াত দিতে। মায়ের কাছে শুনছিলো সোমা যে আগামী মাসে রিয়া আপুর বিয়ে। বেশ কয়েক বছর হলো সোমাদের বাসায় আত্মীয় স্বজনের যাতায়াত বেড়ে গেছে। সাহায্য সহযোগিতা ছাড়াও, তসবির কিংবা পারিবারিক অনুষ্ঠানে সোমাদের উপস্থিতি এখন অনেকের জানো সৌভাগ্যের ব্যাপার।

সোমারা এই বাসায় মুড করেছে বছর পাঁচেক হলো। ছয় বেডরুমের প্রায় সাড়ে চার হাজার স্কয়ার ফিটের ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটটি তৈরিতে সোমার বাবা সোবাহান সাহেব প্রচুর খরচ করেছেন। এক একটি বাথরুম এর ফিটিংসের এর পেছনেই খরচ হয়েছে প্রায় চল্লিশ লক্ষ টাকা।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের সহকারী প্রধান প্রকৌশলী আব্দুস সোবাহান তালুকদার ছাত্র জীবনে বাম রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। সোমার নানা মানে সোবাহান সাহেবের বাবা মাওলানা আতামত আলী তালুকদার ছিলেন পেশ ইমাম। এলাকায় তার অত্যন্ত সুখ্যাতি ছিল। তার জন্যেই সোমাদের গ্রামের বাড়ির নাম ইমাম বাড়ি। স্ত্রীর ইচ্ছায় ছেলেকে মাদ্রাসায় না পড়িয়ে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন মাওলানা আজমত আলী। মেধাবী সোবাহান তালুকদার উপজিলা ফার্স্ট হয়ে এসএসসি এবং এইচএসসি তে বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় নবম স্থান অধিকার করে বুয়েটে ভর্তি হন। ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত থাকলেও লেখাপড়ার কোনো ক্ষতি হয়নি। কৃতিত্বের সাথে লেখাপড়া শেষ করে যোগ দেন গণপূর্ত অধিদপ্তরে।
বাবার কড়া নির্দেশ ছিল ঘুষ খাওয়া যাবে না। তাই চাকরি জীবনের প্রথম দিকের বেশ কয়েক বছর অত্যন্ত সৎভাবে জীবন যাপন করেছেন। সোমা, বাবলু স্ত্রী রেহানা কে নিয়ে বেশ সুখেই দিন কাটছিলো তার। এই ছন্দে পতন হলো সরকার দলীয় এক কন্ট্রাক্টরের কাজের মানের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করার কারণে। 

সততার পুরস্কার স্বরূপ এক বিকেলে সাসপেনশন লেটার হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। লোকে বলে বিপদ যখন আসে, সর্বদিক থেকে একসাথে আসে। এটা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন সোবাহান সাহেব। তাঁর বাবার কিডনিতে সমস্যা দেখা দিলো। মিরপুরের কিডনি হসপিটালে প্রায় দুই মাস চিকিৎসার পর মারা যান মাওলানা আজমত আলী। বাবার চিকিৎসায় জমানো টাকা, রেহানার গয়না, সব একসাথে শেষ হয়ে যায়। বাসা ভাড়া বাঁকি পড়লো। পাড়ার দোকানদারগুলোও পাওনা টাকার জন্যে ঘন ঘন সালাম দেয়া শুরু করলো। আত্মীয় স্বজনরা এমুখো ঘেঁষা বন্ধ করে দিলো। পরিস্থিতি এতটাই বদলে গেলো যে আপন ফুফাতো বোনের জামাই, যার বাসায় ভাড়া ছিল, তিনিও তিন মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি পড়ার কারণে বাসা থেকে বের করে দিলো। সোমা-বাবলু কে নিয়ে একেবারে রাস্তায় নেমে আসতে হলো।

সেদিন অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করে চাকরিতে যোগদান করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না সোবহান সাহেবের। তার চাকরিতে যোগদানের পর ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে থাকে সবকিছু। হু হু করে টাকা আসতে থাকে চারিদিক থেকে। টাকার সাথে সাথে আলগা হয়ে যাওয়া পুরোনো সম্পর্কগুলো আবার তাজা হতে শুরু করে। যেই আত্মীয়স্বজন এক সময় এড়িয়ে চলতে চাইতো, তারাই এখন তাঁর সান্নিধ্য পাওয়ার জন্যে মুখিয়ে থাকে। লোভী কুকুরের মতো বসে থাকে বাইরের বারান্দায়, ঘন্টার পর ঘন্টা। থাকবেই না বা কেন! সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সোবাহান সাহেবের হট কানেকশন কারো অজানা নয়। স্বয়ং সচিব মহোদয় তাকে সমীহ করে চলেন। দুদকের হিসেবে তার অবৈধ সম্পত্তির পরিমান প্রায় পাঁচশো কোটি টাকা। আসলে এর চেয়ে কয়েকগুন বেশি টাকা তার দুবাই আর লন্ডনের রিয়েল এস্টেট মার্কেটে ইনভেস্টমেন্ট করা আছে।

এতো কিছুর পরেও অতৃপ্তির একটা বেদনা মাঝে মাঝেই তাকে ছেঁকে ধরে। চারিদিক শুনা মনে হয় তখন। মনে হয় যেন বস্তুবাদী জীবনের পেছনে ছুটতে ছুটতে হারিয়ে ফেলেছেন অনেক কিছু। সোমাকে উনি বুঝতে পারেন না। এতো করে বলার পরেও মেয়েটা বিদেশে পড়তে গেলো না। এমনকি প্রাইভেট ভার্সিটিতেও এডমিশন নিলো না। একদিন ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে এসে বলে, ভর্তি হয়েছি। রেহানা শয্যাশায়ী আজকে প্রায় চার বছর। সপ্তাহে দুই একটা দিন কথাটা হয় রেহানার সাথে। বাবলুটা ঘর ছেড়েছে বহুদিন হলো।

একদিন সরাসরি মুখের উপর বলে দিলো, তোমার আয়ের সাথে বায়, সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তাই চলে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে আসে মায়ের সাথে দেখা করতে। তার সাথে কথা বলে না। ইদানিং কি সব আন্দোলন করছে কোটা সিস্টেম এর বিরুদ্ধে। আসলে সোমা-বাবলু কিংবা রেহানা তাঁর নৈতিক পতন মেনে নিতে পারেনি।

মৃত্যুশয্যায় বাবার কথাগুলো মনে পরে সোবাহান সাহেবের। মারা যাবার আগের দিন দুপুরে শিং মাছের ঝোল দিয়ে ভাত যেতে চাইলেন। রেহানা বাসায় গেছে বাবার জন্যে রান্না করতে। তিনি বসেছিলেন। এমন সময় বাবা কাছে ডাকলেন। বললেন, বাবা আব্দুস সোবাহান, কাছে আসো। জানি তুমি অনেক অর্থকষ্টে আছো। তবে এই অবস্থা বেশিদিন থাকবে না। সামনে তোমার সামনে দুইটা দরজা দেখতে পাবা। একটা ন্যায়ের আর একটা অন্যায়ের। আপাত দৃষ্টিতে অন্যায়ের পথটিকেই খুব মসৃন সহজ মনে হবে। মনে রেখো অন্যায়ের পথ কখনোই তোমাকে তোমার মঞ্জিলে নিতে পারবে না। হারামের উপার্জনে শান্তি নাই বাবা। আমাদের বংশে হারামের রুজি সহ্য হয় না। বাবা মারা যাওয়ার পরে তার কথা আর রাখতে পারেননি সোবাহান সাহেব। তার পরিণতি ভোগ করছেন এখন। সব থেকেও যেন কিছুই নেই।

তিন.

মুহিতের সাথে সোমার পরিচয় খুব অদ্ভুত ভাবে। পাড়ার ছেলে হিসেবে চিনতো কিন্তু কথা হয়নি কোনোদিন। সোমারা এই এলাকায় আসার পরে বাবলুও যোগ দিয়েছিলো ওদের আড্ডায়। অল্প কিছুদিনের ভেতরেই মুষিত যেন ওকে জাদু করে ফেলছিলো। সারাক্ষন শুধু মুহিত ভাই মুহিত ভাই করতো। কিছুদিন আগেও বাথরুমে বাবার রেজার দিয়ে গাল কেটে ফেলা বাবলু একদিন বলে যে,
-
জানিস আপি, রাষ্ট্রের একটা কমপ্লিট রিফর্ম দরকার।
বাবলুর কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সোমা। বলে,
-
যুব ভালো। কিন্তু করবেটা কে? তোর ওই মুহিত ভাই?
-
মুহিত ভাই একা করবে কেন? এদেশের মানুষ করবে। আর কতদিন এই নিপীড়ন মুখ বুঝে সহ্য করবে মানুষ?
-
তোর মাথায় সমাজতন্ত্রের এই পোকা কে চুকাচ্ছে: তোর মুহিত ভাইকে তো পুলিশে দেয়া উচিত। চায়ের দোকানে বসে বসে বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেদের মগজ ধোলাই করছে।
-
নারে আপু তুই জানিস না। মুহিত ভাইয়ের স্যাক্রিফাইস অনেক। ওরা একটা মুভমেন্ট অর্গানাইজ করছে।
চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে দিতে? তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললো সোমা।
মুহিত ভাই বলে
-
সমাজ সংস্কার হলে রাষ্ট্রের সংস্কার এমনিতেই হয়ে যাবে। আর সমাজ সংস্করের জন্যে প্রথমেই দরকার দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। এই দুর্নীতিবাজদের সামাজিক ভাবে বয়কট করতে হবে। এদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আর এই আন্দোলনের শুরুটা করতে হবে নিজের ঘর থেকে।
নিজের ঘর থেকে মানে কি? তুই কি বাবার বিরুদ্ধে c = 1 গান দেয়া শুরু করবি নাকি?
-
বাবলু হাসে। বলে, চার দেয়ালের ভেতরে গান দিয়ে কি হবে? তাছাড়া  োগান প্রতিবাদের একমাত্র ভাষা নয়, অনেক ভাষার মধ্যে একটা। আরো অনেক রকম ভাবে প্রতিবাদ করা যায়।

কয়েক মাসের মধ্যে বাবলু যেন বেশ বড় হয়ে উঠে। ওর আচার আচরণ পাল্টে যেতে থাকে খুব দ্রত। প্রায়ই বাবার সাথে কথা কাটাকাটি হতো। এতো টাকা কোথা থেকে আসে? চাকরি ছাড়া বাবার কি এমন ব্যবসা আছে? বাসায় তিন তিনটা গাড়ি মেইনটেইন করা হয় কিভাবে? ইত্যদি ইত্যাদি। একদিন বাসা ছেড়ে হলে গিয়ে উঠে। সোমা প্রথমে ভেবেছিলো ছেলে মানুষ, রাগ কমলে কিছুদিন পরে এমনিতেই ফিরে আসবে। দুই মাস পেরিয়ে গেলেও যখন আর আসলো না. তখন আর সোমা ধৈর্য্য রাখতে পারলো না। সোজা উত্তের দোকানে গিয়ে মুহিতকে জিজ্ঞাসা করলো,
-
আমার ভাইকে বিপ্লাবী বানিয়ে নিজে তো মহা সুখে আছেন। লজ্জা করে না আপনার: এতটুকু একটা ছেলেকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসলেন। আর নিজে মহাসুখে আড্ডা দিয়ে দেশ উদ্ধার করে চলেছেন।
-
আপনি বসুন। শুনেছি বসলে অর্ধেক রাগ কমে যায়।
-
আমার রাগ কমাতে হবে না। আমার ভাইকে এনেদিন।
-
আপনার ভাইতো অন্য কোথাও যায় নি। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে উঠেছে। আপনিও তো একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন এবং চাইলেই তার সাথে দেখা করতে পারেন।
-
উপদেশ দেবেন না। আমার দেখা আমি করেছি। অনেকভাবে বুঝিয়েছি।
কিন্তু সে কিছুতেই আসবে না।
-
তাহলে কি তাকে জোর করা ঠিক হবে? তার এই বাড়ি ছাড়াকে শিশু সুলভআচরণ ভাবলে ভুল হবে। এটা একটা মুভমেন্ট। অন্যায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন। যার শুরুটা নিজের ঘর থেকে।
-
আমি এতো কিছু বুঝি না। আমার ভাইকে এনেদিন। তাছাড়া নিজেতো ঠিকই বাসায় আছেন। আপনি ঘর ছাড়ছেন না কেন? কেন শুধু বাবলুই স্যাক্রিফাইস করবে?
-
আপনি এখন অনেক উত্তেজিত হয়ে আছেন? বাসায় যান, আর একবার ভাবুন। তারপরেও যদি আপনার মনে হয় বাবলুর ফিরে আসা উচিত, কথা দিচ্ছি আমি নিজে বাবলুর সাথে কথা বলবো।
সোমা তখন বাসায় চলে এলেও মুহিতের ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার জন্যে শিখাকে ফোন দেয়।
-
শিখা আমাদের এলাকায় মুহিত নামে একটা ছেলে আছে। ওর ব্যাপারে কিছু খোঁজ নিয়ে দিতে পারবি?
আরে এটা কোনো ব্যাপারই না। বাবাকে বললেই হবে। কিন্তু কেন বন্ধুঃ প্রেম করবি নাকি:
-
না প্রেম ট্রেম কিছু না। বাবলুকে উল্টাপাল্টা কিসব বুঝিয়েছে। বাবলু বাবার সাথে ঝগড়া করে বাসা ছেড়ে হলে গিয়ে উঠেছে।
-
কুচ পরোয়া নেহি বন্ধু। কালকের মধ্যেই তোর মুহিতের নাড়ি-নক্ষত্র সব জানতে পারবি।
পরদিন সকাল নয়টায় শিযার ফোন। হাপাতে হাপাতে বলে,
-
এই জিনিস তুই কই পেলি সোমা: এতো অনেক কামেল আদমি।
-
মানে? অবাক হয়ে জানতে চায় সোমা।
আরে মুহিত মানে এহসানুল হক মুহিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিলোসোফিতে অনার্স মাস্টার্সএ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছে। শুধু তাই নয় এই ছেলে রেকর্ড মার্কস নিয়ে পাস করার পরেও বিশ্ববিয়ালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়নি। এই কুতুব ফিলোসোফিতে পড়ার সময় তেও ভাবল ডিগ্রি নিয়েছে। যযারীতি এখানেও প্রথম হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল মেয়ের হার্টথ্রব ছিল ও। মুহিতের বাবা বাংলাদেশের প্রথম সারির দশজন

শীর্ষ ব্যবসায়ীর মধ্যে একজন। প্রায় পঞ্চাশ হাজার কর্মচারী কাজ করে ওদের কোম্পানিতে। মুহিতের বড় ভাই বর্তমান সরকারের একজন খুব পাওয়ারফুল মিনিস্টার। আর এক ভাই শিল্পমন্ত্রণালয়ের সচিব। বিগত সরকারেও মুহিতের মামা দুই দুইটা মন্ত্রণালয় একা সামলিয়েছেন। এছাড়াও মুহিতের দাদা শেখ মুজিবর রহমান সাহেবের খুব কাছের লোক ছিলেন। এরা বনেদি ধনী।

তবে অনার্স এর দ্বিতীয় বর্ষে থাকতে বাবা ভাইদের ব্যবসা রাজনীতি সবকিছুতেই অনিয়মের প্রতিবাদ স্বরূপ মুহিত ঘর ছাড়ে। এই ছেলে ভিন্ন কিসিমের পাগল। গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে গিয়ে এরা একটি অন্য ধরণের সমাজ গড়তে চায়। বর্তমান সরকারের বিপক্ষে এতো কিছু লেখার পরেও যে গুম হয়ে যায়নি তার কারণ ওদের পারিবারিক প্রভাব। এই প্রভাব কতদিন ওকে সেফ করতে পারবে কে জানে। গোয়েন্দা রিপোর্টে ওর নাম লাল কালিতে লেখা হয়েছে আরো বছর দুয়েক আগে।

ধীরে ধীরে সোমা জানতে পারে উত্তের দোকানে আড্ডা দেয়া ছেলেগুলো আসলে স্বস্ব ক্ষেত্রে কীর্তিমান। তাদের ভাবনাগুলো যেন সবারই প্রাণের চাওয়া। সবারই বলতে না পারা অব্যক্ত কথা। তাদের কথাগুলো খুব স্পষ্ট। তারা চায় রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। সোমাও মাঝে মাঝে যোগ দেয় ওদের আড্ডায়।

সেদিন আড্ডায় কায়সার বলছিলো, এভাবে মুখ-চোখ-কান ঢেকে রেখে গান্ধীর তিন বাঁদরের মতো দেশ চলতে পারে না। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত যতগুলো সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় এসেছে তারা ভিন্ন মতবাদের হলেও একটি ব্যাপারে সবার মতাদর্শ এক ছিল। তা হলো কাজের সমালোচনা সহ্য করতে না পারা। যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিৎ করে না. সেই সরকার, সেই রাষ্ট্র ব্যর্থ হতে বাধ্য। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্রই হচ্ছে রাষ্ট্রের জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস এবং নির্বাচিত সরকার তার জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি ৭২ পরবর্তী প্রতিটি সরকারই নিজেদের জনগণের মালিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। কোনো সরকারই জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে পারেনি বরং কিভাবে জনবিচ্ছিন্ন হওয়া যায় তারই প্রতিযোগিতা করেছে সবসময়।

উল্টো সমালোচনা এড়ানোর জন্যে রীতিমতো রাষ্ট্রীয়ভাবে বেতনভুক্ত তোষামোদকারী নিয়োগ দিয়ে রেখেছে। যাদের প্রধান একমাত্র কাজ সরকার এর চারিপাশে ঘোরা এবং গুণগান করা। যেন হীরক রাজার দেশ-সাথে যোগ করে বিপ্লব। কায়সার বিপ্লব ওদের আড্ডার নিয়মিত সদস্য। ওরা দুজনে ছেলেবেলার বন্ধু এবং ব্যবসায়ীক পার্টনার। মুহিতের ভাষায় ভেরি রেয়ার কম্বিনেশন। বুয়েট থেকে পাশ করে নিজেরাই একটা স্টার্টআপ দিয়েছিলো। এখন সেটা ফুলে ফেঁপে একাকার।

মুহিতদের আড্ডার একটা ভালো দিক হল ওরা খুব কঠিন কঠিন কথা কিভাবে যেন খুব সহজ ভাষায় বলতে পারে। ওদের ভাবনাগুলো অন্যের মগজে ঢুকিয়ে দিতে পারে অনায়াসে। সোমা নিজেই তার জ্বলন্ত উদাহরণ। পারিপার্শ্বিক অস্থিরতা ওকে খুব একটা বিচলিত করতো না।
ইদানিং সোমাও ভাবতে শুরু করেছে, আসলেইতো আমরা কি স্বাধীন? আমরা কি প্রাণ খুলে কথা বলতে পারি? চারিদিকে কেমন যেন একটা নীরব ভয় সব সময় কাজ করে। এমনকি ফেসবুকে একটা পোস্ট দেয়ার আগে শতবার ভাবতে হয়। যেমন, কিছু বছর আগে সোমাও একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট শেয়ার করেছিল ফেসবুকে। তাই নিয়ে সোমার বাবা সোবাহান সাহেব তার অফিসে বেশ অস্বস্তির মধ্যে পড়েছিলেন।
তিনি কিছু না বললেও, সোমা বেশ বুঝতে পেরেছিলো বাবার অস্থিরতা দেখে।

মুহিত বলে পরাধীনতার প্রথম শৃঙ্খল হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করা। চারপাশে অনেক কিছুই ঘটবে, কিন্তু তুমি কিছু দেখতে পারবে না, বলতে পারবে না, শুনতেও পারবে না। কারণ, তোমার পায়ে অদৃশ্য এক ভীতির শৃঙ্খল পোড়ানো আছে। তুমি টেরই পাবে না যে ঠিক কখন তোমার প্রথমে নাগরিক অধিকার পরে মানবিক অধিকারগুলো কেড়ে নেয়া হয়েছে। পরিস্থিতিই এমনভাবে তৈরী করা থাকবে যে খুব সাধারণ প্রতিবাদ করতেও তোমার বুক ধড়ফড় করবে।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে সঠিক যোগ্য নেতৃত্ব তৈরী হতে না দেয়া। যেমন, ধরো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি। যেখান থেকে জাতীয় নেতৃত্ব তৈরি হওয়ার কথা। ছাত্র রাজনীতির প্রধান উদ্দেশ্য হলো ছাত্রদের ন্যায্য অধকার নিশ্চিত করণের লক্ষে কাজ করে যাওয়া। অধিকার আদায়ে সরব সোচ্চার হওয়া। এছাড়াও জাতীয় প্রয়োজনে জনগণের পাশে থাকা এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই নেতৃত্বের ট্রেনিং নিয়ে পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে অবদান রাখা।

কিন্তু এখন কি হচ্ছে? সরকারি দলের লেজুড় বৃত্তি করতে গিয়ে তরুণ মেধাবী ছাত্ররা কিভাবে ঝরে যাচ্ছে: তারা বুঝতেও পারছে না দেশকে নেতৃত্ব শুণ্য করতে এবং আমৃত্যু নিজেদের আসন পাকাপোক্ত অদক্ষ্য শাসকদল পারিবারিক কোটায় নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে কি বিভৎস্য ধ্বংসের খেলায় মেতেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পর্যন্ত নিজেদের নীল-সাদ্য দলে ভাগ করে নিয়েছে। সাদা দলে নাম লেখানো শিক্ষক যখন নিজ দলের ছাত্রদের অনৈতিক সুবিধা দেয়, তখন সে একটুও ভাবে না অন্য দলের অথবা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে সে কতটা নিচে নেমে যাচ্ছে। পট পরিবর্তনের সাথে সাথে আবার একই কাথের পুনরাবৃত্তি ঘটছে নীল দলের সাথে। দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি বিশেষ বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া এই শিক্ষকরা কিভাবে তার ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তাদের সম্মান আশা করবে: হ্যা, কিছু শিক্ষক আছেন যারা এখনো তাদের নীতি বিসর্জন নীতি বিসর্জন দেননি। কিন্তু তারা সংখ্যায় এতই নগন্য অথবা তাদের আওয়াজ এতটাই ক্ষীণ যে. জাতি তাদের দেখতেও পায় না, শুনতেও পায় না।

এই নীতি বিবর্জিত শিক্ষকদের দলে ভেড়ার পালের মতো যোগ দিচ্ছে কবি-সাহিত্যিক, চাটুকার সাংবাদিক সহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। ফ্যাসিস্টতন্ত্র কায়েম করার জন্যে জাতির বিবেককে মেরে ফেলতে হয়। তাতে সাধারণ মানুষ অন্যায়কে অন্যায় বলতে ভুলে যায়। রাষ্ট্রীয় যেকোনো শোষণ নির্ধিধায় মেনে নেয়। একনায়ক ফ্যাসিস্টদের ক্ষমতার গদিটা তখন পোক্ত হয়। অনেকটা সত্যজিৎ রায়ের 'হীরক রাজার দেশে ভরিতে খনিতে কাজ করা শ্রমিকের মতো। দেশে এখন যে অবস্থা চলছে এটাকে ফ্যাসিজমের চূড়ান্তরূপ বলা যায়।

শেখ হাসিনা বিগত দশবছরে অত্যন্ত দক্ষ হাতে ফ্যাসিজমকে আধুনিকায়ন করেছেন। এককভাবে কুক্ষিগত করেছেন সকল ক্ষমতা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সর্বপ্রধান নিয়ামক ভোট', সেটিকেও করায়ত্ত করেছেন নির্লজ্জভাবে। শুধু তাই নয় এই নিয়ে কারো টু শব্দটিও তিনি সহ্য করছেন না। গৃহপালিত বিরোধী দল তৈরী করেছেন। রীতিমতো উৎসব করে লুটপটি চালাচ্ছেন তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে। এই মুহূর্তে তিনি নিজেকে অধিষ্টিত করেছেন ভগবানের পর্যায়ে। কিন্তু এভাবে আর চলতে পারে না। দেশে আর একটি অভ্যুত্থান অত্যাসন্ন এটুকু বলে একটু ধামে মুহিত। মুগ্ধ হয়ে মুহিতের কথা শোনে সোমা। কিন্তু শেখ হাসিনার বিকল্প কে?

সোমার এই কথার জবাবে মুহিত বলে, ফ্যাসিজমের এর একটি ধারা হচ্ছে জনগণের মাথায় ভোজে ঢুকিয়ে দেয়া, আমি ছাড়া তোমাদের আর কে আছে? আমাদের প্রথাগত রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে সোমা। আওয়ামীলীগের সাথে জাতীয় পার্টি কিংবা বিএনপি এর সাথে জামাত জোট এরাই বাংলাদেশের আঠারো কোটি মানুষের একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী নয়। নিশ্চয় আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে দেশ গড়ার কাজে। 'রাজনীতি ভালো লোকেরা করে না, এই ধারণা ভাঙতে হবে। রাজনীতি ভালো লোকেরা করে না বলেই খারাপ মানুষেরা সেই স্থান পূরণ করে নেয়। আমি আর তুমি ভালো মানুষ হয়ে তখন ওই খারাপ মানুষগুলোর অধীনেই কাজ করতে কোনো আপত্তি করি না। কিছু দিনের মধ্যেই আমরাও খারাপ মানুষ হয়ে যাই। আমরা এই শৃঙ্খলটাই ভাংতে চাই।

আর এটা তখনি সম্ভব হবে যখন আপামর জনসাধারণ এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করবে। আমাদেরকে তৈরি থাকতে হবে সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্যে। তবেই আমরা অমানিশার এই অন্ধকার হটিয়ে একটি নতুন সূর্যোদয়, একটি নতুন ভোর দেখতে পাব।

মজার ব্যাপার লক্ষ্য করেছো, ৯১ পরবর্তী সকল সরকারের শাসনামলে যতদিন সত্যিকারের বিরোধী দল ছিল, অনাসব ব্যাপারে মতবিরোধ থাকলেও একটি ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোনো ভিন্নমত ছিল না। আর তাহলো শুল্কমুক্ত গাড়ী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে দুইদল সাদা নীল। অন্যসব ব্যাপারে মারামারি করলেও, তারাও একটি বিষয়ে একমত। তাহলো সান্ধাকালীন বাণিজ্যিক ক্লাস বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নেয়ার সুযোগ। কি অবস্থায় আছে দেশ, চিন্তা করা যায়?

চার.

বেশ কিছুদিন ধরে যে কোটা বিরোধী যে আন্দোলন চলছিল তা ধীরে ধীরে আরো ঘনীভূত হচ্ছে। বাবলুর জন্যে খুব চিন্তা হচ্ছে সোমার। টিএসসিতে মাধায় পতাকা বেঁধে বাবলুকে প্রায় দেখা যাচ্ছে আন্দোলনের অগ্রভাগে। হাসিমুখে সাক্ষাৎকার দিচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলোতে। মা খুব দুশ্চিন্তা করছে বাবলুর জন্যে। গত সপ্তাহে ক্লাসে যাওয়া হয়নি। শিখা গিয়েছিলো কিনা জানতে ফোন দিলো সোমা।
-
হ্যালো শিখা?
-
হ্যালো সোমা। আমি বাইরে একটু জোরে বল।
-
তুই কি লাস্ট উইকে ক্লাস গিয়েছিলি?
-
নাহ্। ক্লাস হচ্ছে নাতো। তুই কই?
-
আমি বাসায়। তুই?
-
আমি টিএসসি তে কোটা বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছি।
তুই কোটা বিরোধী আন্দোলনে গিয়ে কি করছিস? তুই কি বিসিএস বসবি নাকি?
-
আরে ধুর! আমিতো বাইরে চলে যাচ্ছি ভাইয়া আর মার কাছে। তবে যাবার আগে ছাত্রদের ন্যায্য দাবির পক্ষে নিজের অবস্থান জানান দিয়ে যাচ্ছি। এটলিস্ট নিজের বিবেকের কাছে ক্লিয়ার থাকতে চাই। বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোকে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলছে। এই অবস্থায় কিভাবে ঘরে বসে থাকি বল?
-
আঙ্কেল তোকে আসতে দিলো?
-
আরে না, আসতে দিতে চায়নি। রীতিমতো পুলিশ পাহারা দিয়ে রেখেছিলো যাতে আমি বাইরে বের হতে না পারি। কিন্তু আমাকে তো চেনে না। এমন টাইট দিয়েছি যে আগামী সাতদিন বিছানা থেকে উঠতে পারবে না।
-
কি করেছিস তুই? আতংকিত হয়ে জিজ্ঞেস করে সোমা।
-
দুই দিন ধরে তক্কে তত্ত্বে ছিলাম। আজ সুযোগ বুঝে খাবারের সাথে উৎমধঃরড়হ ঈৎড়ঃড়হ মিশিয়ে দিয়েছি। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই টয়লেটের সাথে একদম ডাইরেক্ট কানেকশন। একেবারে ছেড়াবেড়া অবস্থা। এটা আমার ছাত্র হত্যার প্রতিবাদ।
-
কি মিশিয়েছিস?
-
চৎধঃরড়হ দিৎড়ঃড়হ- যাঁটি বাংলায় যাকে বলে জামাল গোটা'
-
বলিস কি: আছেলে কেমন আছে?
-
ভালো না। বাবার একই অবস্থা। ফোন দিয়েছিলাম। হসপিটালে ভর্তি হয়েছে। গলা দিয়ে স্বর বের হয় না। কু কু করছিলো।
-
তুই পারিস ! শোন, বাবলুও যোগ দিয়েছে ওই আন্দোলনে।
-
হা দেখলাম তো। আজকেও দেখা হয়েছে।
-
আমার ফোন ধরছে না। দেখা হলে বলিস মা খুব দুশ্চিন্তা করছে। বাসায় আসতে বলেছে।
-
বলবো। তবে মনে হয়না আসবে এখন। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। পুলিশ আগে থেকেই সরকারি বাহিনীর মতো আচরণ করছে। গতকাল কাদের কাক্কু (ওবায়দুল কাদের। ছাত্রলীগকে ওপেন লাইসেন্স দিয়েছে সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের উপর এট্যাক করার জন্যে। কুকুরগুলো এখন হামলে পড়েছে আমাদের উপর।
-
কি বলিস?
-
কালকে রোকেয়া হলে, ইডেন কলেজে ছাত্রীদের উপর এট্যাক হয়েছে, টিভিতে দেখিস নি? আচ্ছা শোন, মুহিত ভাই কইরে! উনাকে একটু সাবধানে থাকতে বলিস। পরশু বাবাকে কার সাথে যেন কথা বলতে শুনলাম। কিসব যেন লিস্ট বানানো হচ্ছে। মুহিত ভাই, কায়সার ভাই, বিপ্লব ভাই সবার নাম আছে ওই লিস্টে। আরো কিছু ইয়ং ছেলে পেলের নাম শুনলাম। মুহিত ভাইয়ের ভাই বোধহয় এইবার খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না। সরকার অনেক বেকায়দায় আছে।
-
আচ্ছা বলবো।
শিখার সাথে কথা শেষ করে সোমা বাবার ঘরে গেলো। দুইদিন ধরে বাবা অফিস যাচ্ছে না। কোনো সমস্যা হলো নাকি?
-
কিছু বলবি মা?
-
অফিস যাচ্ছো না যে? কোনো অসুবিধা: শরীর খারাপ?
-
না এমনিতেই। শরীরটা খুব একটা ভালো না। বাবলুর জন্যে খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। দেশের অবস্থা ভালো না। যেকোনো সময় একটা খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে।
-
আমার ফোনও ধরছে না। চিন্তা করো না বাবা। বাবলু কে আমি শিখাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছি। বলেছি মার শরীর খারাপ। বাসায় আসতে।
-
ভালো করেছিস মা। আমার কথা বললে তো আর আসবে না: ওকে আমি দোষ দেই না। আমার রক্ত ওর শরীরে। অন্যায়ের প্রতিবাদ তো করবেই। আমি হয়তো পচে গেছি কিন্তু আমার রক্ত ঠিকই দাঁড়িয়ে গেছে। ওর জন্য আমার গর্ব হয় মা।

জুলাইয়ের শুরু থেকেই পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে। ছাত্র আন্দোলন যেন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এদিক দিয়ে আওয়ামীলীগ নেতারা ইচ্ছেমতো বিবেক বর্জিত বক্তব্য দিয়েই চলেছেন। আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একটা জাতীয় কার্টুন পরিণত হয়েছেন। এই লোকটা নাকি একসময় ছাত্র রাজনীতি করতো। ১১দফা আন্দোলনের সক্রিয় নেতা ওবায়দুল কাদের জেলে থাকা অবস্থায় ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিল। সময়ের কি অদ্ভুত খেলা। এক সময়ে জুলুমের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা কণ্ঠ নিজেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠের টুটি চেপে ধরছেন। শেখ হাসিনা নিজেও বোধহয় জানেন না তিনি কি করছেন।

চারপাশে এতো চাটুকার: সালমান এফ রহমান, আরাফাত, হাসান মাহমুদ, আসাদুজ্জামান কামাল দিয়ে ঘিরে আছেন সব সময়। সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে এরাই প্রধান অন্তরায়। তিনি বোধহয় জানতেও পারেননি ঠিক কখন তিনি ডজনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন: উমার বাবার ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই ঘটেছিলো। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্যে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত, ত্যাগী নেতাদের নিষ্ক্রয় করে রাখা, চাটুকারদের কাছে টেনে নেয়া নিজ পরিবারের সদস্যদের লাগাম টেনে ধরতে না পারা। তাকে জানবিচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো। তাঁর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা দুই বছরের মধ্যে তলানিতে এসে ঠেকেছিল। পরিনাম ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫।

দিনের পর দিন দেশের অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীদেরও আন্দোলনের মাঠে দেখা যাচ্ছে এবার। সরকার এই আন্দোলন খুব সহজে দমাতে পারবে বলে মনে হয় না। গোটা সরকারে কি এমন কেউ নাই যে. এদের সাথে কথা বলে, এদের ন্যায্য দাবিগুলো নিয়ে শেখ হাসিনার সাথে কথা বলতে পারে?

১৬ জুলাই ২০২৪। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সায়ীদকে নিখুঁত নিশানায় গুলি করে মেরে ফেললো পুলিশ। গোটা জাতি প্রত্যক্ষ করলো কিভাবে নিরস্ত্র ২৩ বছরের যুবককে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি চালিয়ে হত্যা করলো রাষ্ট্রীয় বাহিনী। এই হত্যাকান্ড মেনে নিতে পারেনি সারাদেশের মানুষ। প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে গোটা দেশের মানুষ। সরকার পুলিশ তারদলীয় হেলমেট বাহিনীকে সয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে নামিয়ে দিলো আন্দোলন প্রতিহত করতে। ফেসবুকের কল্যানে বিভিন্ন এলাকা থেকে হেলমেট বাহিনীর নিরীহ জনতার উপরে আক্রমণের ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে যদিও বেশিরভার সংবাদ মাধ্যম শুধু আন্দোলনকারীদের জ্বালাও পোড়াও এর খবর প্রকাশ করছে।

হঠাৎ করে ১৮ তারিখ থেকে করে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। কারো সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় নেই। মোবাইল
নেটওয়ার্কেও ঘের ঘের আওয়াজ হয়। ঠিক মতো কথা শোনা যায় না। ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো এক রাতের মধ্যেই খালি করার নির্দেশ এসেছে। ডিসি, প্রক্টর সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অভিভাবকগুলোর মাথায় মাধায় কি কি আসলোনা যে এই দুর্যোগের মধ্যে এই রাতের বেলা এই ছেলে মেয়েগুলো বাসায় ফিরবে কি করে? গত কয়েকদিন ধরে বাবলুর কোনো খবর নেই। মা খুবই দুশ্চিন্তা করছেন।

রাত থেকে আন্দোলকারীদের দমাতে, তাদের উপর সাঁড়াশি আক্রমণ চললো। চারিদিকে শুধু গুলির আওয়াজ। বিচ্ছিন্নভাবে যে খবর পাওয়া যাচ্ছিলো তা ভয়াবহ। যেন চারিদিকে মৃত্যুর মিছিল। এই ভয়াবহতা উপেক্ষা করেই যাবার পানি হাতে সাধারণ মা বোনদের রাস্তায় নেমে আসতে দেখা গেলো। সোমার মনে পড়লো মুহিত এর কথা। মুহিত বলেছিলো আন্দোলনে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এলে তখনই তা গণঅভুযানে রূপ নেবে। আর গণ-অভ্যুত্থান বন্দুকের নলের কাছে নোটি স্বীকার করে না। কোনো স্বৈর শাসকের পক্ষেই গণ-অভ্যুত্থান ধামানো সম্ভব না।

১৮ থেকে ২৩ জুলাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদ অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় পুলিশ দলীয় কর্মীদেরদ্বারা কয়েকশো নিরীহ মানুষকে মেরে ফেললো। স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করলো একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। রাস্তায় রাস্তায় লাশ পরে থাকতে দেখা গেলো। কি বিভৎস্য সেই দৃশ্য।

মুহিতের সাথে কথা হয়না বেশ কিছুদিন। শিখার কথাও মুহিতকে বলা হয় নি এখনো। ওকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না কয়েকদিন ধরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা কে দেখা গেলো ছাত্রদের পক্ষে মাঠে নেমেছেন। সব চেনা মুখ। যেকনো জাতীয় বিপর্যয়ে শুধু এদেরই দেখা যায়। এনারাও বয়োবৃদ্ধ হতে চলেছেন। এনারা চলে গেলে কে আসবেন ছাত্রদের পক্ষে কথা বলতে: মুহাম্মদ জাফর ইকবাল তার চিরচেনা রূপে আবার আবির্ভাব হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রদের হত্যা নিয়ে তার তেমন দুশ্চিন্তা না হলেও তিনি শেখ হাসিনার উগরে দেয়া গালির প্রতিবাদে ছাত্রদের তুই কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার গোন একদমই মেনে নিতে পারেন নি। হাতে লেখা ছোট্ট একটা চিঠি কবি তুলে (কয়েকটি বানা ভুলসহ) ফেসবুকে পোস্ট করেছেন দ্বিতীয় মেয়াদে গর্তে ঢোকা এই প্রফেসর।

নিলয় স্যার কে দেখা গেলো একদিন নীল দলের ঝান্ডা হাতে গণমানুষের এই স্বতস্ফূর্ত আন্দোলনকে বিএনপি জামাতের দুষ্কর্ম আখ্যা দিয়ে ব্যানার হাতে ভার্সিটির গেট দাঁড়িয়ে আছে সমগোত্রীয় আরো কিছু শিক্ষক নামের কুলাঙ্গারের সাথে।

শিখা বলছিলো এই লোক নাকি একটি বিশেষ কোটায় চাকরি পেয়েছে। হয়তো তারই প্রতিদান দিচ্ছে এখন। সন্তানসম ছাত্রদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে তাদের এই নষ্টামো দেখে মনে হয় মুহিত ঠিকই বলেছিলো, দেশের শিক্ষিত শ্রেণী পচে গেছে।
সোমা ঘরে বসেছিল। বারান্দায় যাওয়া যাচ্ছে না। পরশুদিনও একটি বাচ্চা ছেলে বারান্দাতে গুলি যেয়ে মারা গেছে। একটি অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসছে কিছুক্ষন থেকে। সোমা ধরবে না ধরবে না করেও ফোনটা ধরলো। ওপাশ থেকে মুহিতের গলা।
-
সোমা কেমন আছো?
ভালো, কিন্তু তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? তুমি ঠিক আছোতো
মুহিত: আর এটা কার ফোন নম্বর?
-
হ্যা আমি ভালো আছি। এটা আমার নম্বর নয়। তুমি কিন্তু ভুলেও এখানে কল করো না।
থ্যাংক গড। শোনো শিখা বলছিলো কিসব যেন লিস্ট হচ্ছে: তোমার নাম ওখানে আছে, একটু সাবধানে থাকতে। কি হলো কথা বলছো না কেন?
-
সোমা, একটি খারাপ খবর আছে?
-
কি হয়েছে বোলো না:
হঠাৎ করে পাথরের মত কি যেন একটা চেপে বসলো সোমার বুকে। যেন নিঃশাস বন্ধ হয়ে আসছে। তাহলে কি বাবলুর কিছু হলো: ঠিক আছে তো
-
বাবলু কোথায়: বাবলু কেমন আছে মুহিত?
-
শত্রু হও সোমা। বাবলু দেশের জন্যে শহীদ হয়েছে। খুব কাছ থেকে ছোড়া পুলিশের গুলিতে একটু আগে বাবলু মারা গেছে।
সোমার কাছে মনে হলো হটাৎ করেই যেন পুরো পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেলো। তারপরে বেশ কয়েক মুহূর্তে নীরবতা। মুহিতের কাছে যেন মনে হলো অনন্তকাল। নীরবতা ভেঙে সোমাই খুব ঠান্ডা মাথায় জানতে চাইলো
-
বাবলু এখন কোথায় আছে?
-
ঢাকা মেডিকেল এর মর্গে।
ধীর পায়ে সোমা বাবার ঘরে প্রবেশ করে। ওর সোমার কাছে মনে মনে হলো যেন একজন পাথরের মূর্তি বসে আছে।
-
বাবা! বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো সোমা।
-
আমি শুনেছি। যাও মা. তোমার মায়ের কাছে বলে এস।

পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা কিভাবে কাটলো সোমা জানে না। মীরপুর কবরস্থানে বাবলু কে দাফন করা হলো। বাবলুর বুক থেকে তিনটি রাইফেলের গুলি বের করা হয়েছিল। এছাড়াও বুকে পিঠে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া শটগানের গুলি গুলো আর বের করা সম্ভব হয়নি। ওই অবস্থায় বাবলুকে দাফন করা হয়।

পরিশিষ্ট

জাতিকে অবাক করে দিয়ে শেখ হাসিনা ২৫ জুলাই মেট্রোরেল পরিদর্শনে গিয়ে অঝোরে কান্নাকাটি করলেন। জাতি পরিচিত হলো সভা সমাজের এক মডার্ন ডাইনির সাথে। যিনি দেশের স্থাপনা ক্ষতিকে পাঁচ শতাধিক মানুষের জীবনেও থেকেও বেশি মূল্যবান মনে করেছেন। নুতন এই ডাইনির সাথে সাথে কাঁদলেন আরো কিছু চাটুকার।

শহীদুল্লাহ কায়সার এর মেয়ে শমী কায়সারকে দেখা গেলো দলবল নিয়ে বিটিভি ভবন পরিদর্শন করতে এবং শেষে একইভাবে কান্নাকাটি করতে। টেলিভিশনের টকশোতেও কয়েকজনকে কান্নাকাটি করতে দেখাগেলো সেতু ভবনও টোলপ্লাজোয় আগুন দেখে। দেশে শুরু হয়ে গেলো কান্নার রোল। কে কত বেশি কাঁদতে পারে এবং সেই ভিডিও করে ফেইসবুক পোস্ট দিতে পারে। কুমড়ো পটাশ আরাফাত টকশোতে এসে বলতে লাগলো আন্দোলনে যারা গুলি খেয়েছে তাদের বেশিরভাগই মাদকাসক্ত। তা নাহলে কেউ পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক পেতে দাঁড়ায় না। এই ছাগলটাকে কে বোঝাবে দেশপ্রেমই একটা বড় নেশা। পুলিশের বন্দুকের সামনে দাঁড়াতে এই নেশাই যথেষ্ট। অন্য কোনো মাদক লাগে না। ভাবতে অবাক লাগে যে, ৩৩০ সংসদ সদস্যের একজনও এই নৃশংস এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করলো না।

পুত্রশোক সইতে পারেন নি সোমার মা। উনি মারা যান বাবলুকে কবর দেয়ার দুই দিন পরেই। ৩০ সে জুলাই। তিন তারিখে মুহিতের খোঁজে পুলিশ এসেছিলো সোমাদের বাসায়। ৭১ এর ২৫ সে মার্চের মতো পুলিশ বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে জানতে চাচ্ছিলো কোথাও করো ছাত্র লুকিয়ে আছে কিনা? কায়সার ভাই ফোন করে পরে জানিয়েছিল মুহিত পুলিশের হাতে ধরা পরে তারিখ দুপুরে। মুহিতের ভাই বাবা অনেক চেষ্টা করে ছিলেন। কিন্তু কাজ হয়নি। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে সেই রাতেই হত্যা করা হয় মুহিতকে। মুহিতের লাশও পাওয়া যায়নি।

তারিখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার আগে শেষ হত্যাযজ্ঞ চালায়। এক রাতেই হত্যা করা হয় তিনশোরও অধিক নিরস্ত্র-নিরীহ মানুষকে। কায়সার ভাইদের অফিসেও বেশ ভাঙচুর হয়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হসপিটালে নেয়ার সময় রিকশাতেই মারা যান বিপ্লব ভাই। সব মিলিয়ে হাজারের উপরে নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। বাদ যায়নি পাঁচ বছরের শিশু থেকে ৮০ বছরের বুড়ো পর্যন্ত। কয়েক হাজার আহত হয়ে হসপিটালে। যার মধ্যে অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন।

শিখা হসপিটালে। গুলি লেগেছিলো পায়ে। বাঁ পা টা কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। শিখা কল করেছিল গতকাল। বললো,
-
জানিস সোমা, নিলয় স্যার কানাডা চলে গিয়েছে। আমি বলেছিলাম না ভাগবে: কানাডা গিয়ে হারামিটা আবার ফেইসবুক পোস্ট দিয়েছে যে শিক্ষক নিপীড়ণের প্রতিবাদস্বরূপ চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়ে তিনি দেশ ছেড়েছেন। কত বড় ভন্ড, চিন্তা কর।
-
দেখেছি বললো সোমা।
-
সোমা সবাইতো আমাকে দেখতে এলো। তুইতো আসলি না?
-
আসবো শিখা।
-
জানি, আমাকে হুইল চেয়ারে দেখতে তোর কষ্ট হবে। তাই আসছিস না। আঙ্কেল কে নাকি পুলিশ এরেস্ট করেছে?
-
হ্যা।
-
কিন্তু কেন?
-
ঘুষ দুর্নীতির জন্যে।
-
শোন, চিন্তা করিস না। আমার বাবাও কট খেয়েছে। বাছাধনেরা এইবার
বুঝবে কত ধানে কত চাল!
-
এইসব কথা শুনতে ভালো লাগছে না শিখা।
-
মুহিত ভাইয়ের কথা আমি শুনেছি। আসলে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আগে যেকেই রিপোর্ট ছিল যে চলমান এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড মুহিত। মুহিত ভাই অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। জন্মেছিলেন শুধু অন্যের জন্যেই। তুই তো খুব একা হয়ে গেলি সোমা?
রাখি শিখা। পরে কথা হবে।

আর একটু কথা বল। বিছানায় শুয়ে থাকি তো ভালো লাগে না। আমার আর পাহাড়ে যাওয়া হলো না সোমা।
এই প্রথম সোমার মনে হলো শিখা কাঁদছে। শিখাকেও কখনো কাঁদতে দেখেনি। কিছু না বলে সোমা আস্তে করে ফোনটা রেখে দিলো। নিলয় স্যার এর পোস্টটি সোমা দেখেছিলো। তার জন্যে একটা রিপ্লাই লিখেছিলো।

আপনার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্যে বোধোদয় হয়েছে দেখে খুশি হলাম। আশা করি পট পরিবর্তনের সাথে সাথে এই বোধোদয় ডুবে যাবে না, জাগ্রত থাকবে আমৃত্যু। আপনি ভালো পড়াতেন সন্দেহ নেই। তাইতো অল্প কিছুদিনের ভেতরেই আপনি আমাদের কাছে অনেক প্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠেছিলেন। তবে ভাবতে অবাক লাগে, আপনার পদত্যাগের কারণ শুধু৫ তারিখ পরবর্তী শিক্ষক নিপীড়ন। আপনার ছাত্র বাবলুর শরীরের ১৬০ টি ছিদ্র কি আপনাকে মর্মাহত করেনি: বাবার সাথে ছাদে খেলতে থাকা পাঁচ বছরের প্রিয়ার বুক এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাওয়া কি আপনাকে ব্যষিত করেনি? ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ১৭ বছরের ফারহান ফাইয়াজ এর সাদা শার্টের উপর রক্তে ভেজা লাল বুকটি, দেখেও কি আপনার মনে কাঁপন ধরে নি! হাজারের উপরে মানুষ মারা গেলো, তাতেও আপনি নির্বিকার রইলেন। কয়েক হাজার আহত হয়ে হাসপাতালে, তাতেও আপনার মুখে রা নেই। নিজ দলের কিছু শিক্ষককে নাজেহাল হতে হলো, তাতেই আপনার পরমাত্মায় যা লেগে গেলো: বড়োই অদ্ভুত!! শিক্ষক হিসেবে আপনি মহান। শুধু ছোট্ট একটি অনুরোধ করি, জীবনে আর যাই করেন, শিক্ষকতা করবেন না। ওখানে আপনাকে মানায় না।

পরে আর পোস্ট করা হয়নি। কি হবে করে? ইদানিং রাতে আর ঘুম হয় না। অনেকদিন পরে সোমা কফি হাতে বারান্দায় বসলো। সামনের মসজিদ থেকে ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে। মুসুল্লিরা একে একে হেটে মসজিদের দিকে যাচ্ছেন। দেখতে ভালো লাগছে। বাবা আগে প্রতি শুক্রবারে বাবলুকে নিয়ে মসজিদে যেতেন। বাবলুটা পাঞ্জাবি পায়জামা পড়তে চাইতো না। মা জোর করে পরিয়ে দিয়ে মাথায় টুপি দিয়ে দিতেন। বাবলুর কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চক্ষের কোনায় জল চলে এসেছিলো বুঝতে পারেনি সোমা। আস্তে আস্তে চারিদিকে আলো ফুটতে শুরু করেছে। মুসুল্লিরা নামাজ শেষে ফিরছেন। সামনের উত্তের দোকানিও দোকান খোলার তোড়জোড় শুরু করেছে। এই মুহূর্তে সামনের অংশটা ঝড় দিচ্ছে। আচ্ছা মুহিত কি এমন একটি নতুন সূর্যোদয় দেখতে চেয়েছিলো: এমন একটি ভোরের জন্যই কি অপেক্ষা করেছিল।

লেখক: শেখ শুভ

 

 

এনএম/ধ্রুবকন্ঠ

বিষয় : সাহিত্য লেখক ভোরের অপেক্ষায়

আপনার মতামত লিখুন

ধ্রুবকন্ঠ | Dhruba Kantho

বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫


ভোরের অপেক্ষায়...

প্রকাশের তারিখ : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫

featured Image

এক.

কফি হাতে সোমা বারান্দায় এসে দেখে মুহিত নিচের টং দোকানে বসে সিগারেট ফুকছে। কটকটে হলুদ রঙের গেঞ্জির সাথে জিন্সের প্যান্ট। পেছনে ঘাড়ের কাছে ফুটো হওয়া এই গেঞ্জিটাও পরে আছে আজকে সাত দিন ধরে। সোমা অবশ্য কখনো ওকে প্যান্টটি বদলাতে দেখেনি।

সোমার ধারণা, গত এক বছরে এই প্যান্ট ওর কোমর থেকে কেউ নামাতে পারেনি। ঢাকার চটচটে গরমে এক কাপড়ে কেউ সাতদিন থাকতে পারে, এটা মুহিতকে না দেখলে সোমা বিশ্বাসই করতে পারতো না।

গত কয়েকদিন লাপাত্তা ছিল মুহিত। ফোনেও পাওয়া যায়নি।

সোশ্যাল মিডিয়াতেও ইন্যাক্টিভ ছিল। এমন খুব একটা হয়না। ফোন না ধরা কিংবা ম্যাসেজের রিপ্লাই না করা ওর স্বভাব কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াতে অনুপস্থিত মানে সিরিয়াস কিছু।

এত সকালে টঙের দোকানে ওকে দেখে সোমার রাগ করা উচিত।

কিন্তু কেন যেন খুব ভালো লাগছে সোমার। দোকানের বেঞ্চিতে মুহিতের বসার জায়গাটা ফিক্সড। ওখানে বসলে সোমাদের বারান্দা থেকে শুধু ওর মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল পিঠ দেখা যায়। গত দুই বছরে সোমা ওকে অন্য কোথাও বসতে দেখেনি। সাধারণত মুহিত ওর বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সন্ধ্যার পরে আড্ডা দিতে বসে ওই দোকানে।আড্ডা চলে গভীর রাত পর্যন্ত। সন্ধ্যার দিকে পনের বিশজন থাকলেও রাতের দিকে একটু ফাঁকা হয়ে আসে। তখন ওরা পাঁচ/ছয় জনই থাকে। কোথায় ছিল জানতে মুহিতকে কল দিলো সোমা।
-
কোথায় ছিলে?
-
গর্তে। হাসতে হাসতে বললো মুহিত।
একটা কল দিতে পারতে?
-
উপায় ছিল না। পারলে দিতাম। তুমি কেমন আছো?
-
ভালো। তুমি?
-
আমি ভালো নেই সোমা? কিভাবে ভালো থাকি বোলো? স্বাধীন দেশে মুক্ত বাতাসে কথা বলার ক্ষমতা এই জাতি হারিয়ে ফেলছে। শোষণের এক হাত মুখের সাথে নাকও চেপে ধরে আছে। এভাবে বেঁচে থাকা যায়?
-
তুমি একা কি করতে পারবে?
-
আমি একা নই সোমা? যাই হোক খুব বেশি প্রয়োজন না হলে আমাকে ফোন করো না। দরকার হলে আমিই তোমার সাথে যোগাযোগ করবো।
মুহিত ফোন রাখতেই শিখাকে কল করলো সোমা। আজকে ভার্সিটিতে যাবে কিনা জানতে?

ইদানিং প্রায়ই ছোট খাটো আন্দোলন হচ্ছে ভার্সিটিতে, কোটা সিস্টেম নিয়ে। যদিও সরকার দলীয় ছাত্রনেতারা কাউকে তেমন দাঁড়াতে দিচ্ছে না, তারপরেও প্রায় প্রতিদিনই মিছিল মিটিং হচ্ছে। হল থেকে ছাত্রীরাও যোগে দিচ্ছে প্রতিবাদ মিছিলে।
হ্যা সোমা বল? ফোন রিসিভ করে শিখা বলো।
-
আজ কি ভার্সিটিতে যাবি?
-
যাবো। আজকে নিলয় স্যারের ক্লাস আছে। তুই চলে যা। দশটায় ক্লাস।
নারে আজকে আসতে পারবো না। এই জন্যই তোকে ফোন দিলাম। তুই নোটগুলো নিয়ে নিস।
ঠিক আছে, কিন্তু আসবি না কেন? তোর হিরো কি ব্যাক টু দা টঙের দোকান?'
-
হুমম!
-
নিশ্চয় ফুটোওয়ালা হলুদ গেঞ্জি পরে বসে আছে?
-
হ্যা।
-
আর তুই কি করছিস? পেছন থেকে ওর চওড়া কাঁধ ঝাঁকড়া চুলের সাথে বিড়ি ফুঁকা দেখছিস? তোকে নিয়ে আর পারি না।
-
কি করবো তাহলে?
-
কি করবি মানে? তুই কি ভাবছিস যে মুহিত ভাই তোকে ভর সন্ধ্যায় বেড়িবাঁধে চাঁদ দেখাতে নিয়ে যাবে? নাকি ভ্যালেনটাইন ডে'তে হীরের আংটি দিয়ে চমকে দিবে? এখনো সময় আছে। নিজেই নিজেকে উনার কাছে সঁপে দে। কয়েকদিনের যে শারীরিক সুখ পাবি, সেটা দিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিবি। হে হে হে...
-
কি যা তা বলছিস। তোর মুখে কিছুই আটকায় না।
-
যা তা বলছি না বন্ধু। বাস্তব কথা বলছি। তুই ভুল মানুষের প্রেমে পড়েছিস। মুহিত ভাই ঘর-সংসার করা টাইপ ছেলে না। মুহিত ভাইয়েরা কালে ভান্দ্রে দুই একটা জন্মায়। বারুদের মতো জ্বলে উঠে। তারপর একদিন টুপ করে পুলিশের গুলি খেয়ে মরে যায়। যাওয়ার আগে আশেপাশের কিছু ছেলে পেলের মাথা নষ্ট করে দিয়ে যায়। তোর মতো দুই একটা মেয়ে দুনিয়াতে রেখে যায়, যারা না পাওয়ার বেদনা নিয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দেয়। এই হচ্ছে ধ্রুব সত্য। রাখছি। আমার খেলা শুরু হয়ে যাচ্ছে।

শিখাটা এমনই। ওর মুখে কিছুই আটকায় না। বাঙালি সুন্দরী বলতে যা বোঝায় সেরকম না হলেও, ওকে অনায়াসে সুশ্রী বলা যায়। ওর দৈহিক গড়ন বেশ পেটানো। একফোঁটা মেদ নেই শরীরে। নিয়মিত টেনিস খেলে ঢাকা ক্লাবের পাশের কোর্টে। ওর বাবা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেছুর রহমান ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ওর বাবা মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে কয়েক বছর আগে। ওর মা আর বড় ভাই এখন অস্ট্রেলিয়াতে সেটেলড। রয়ে গেছে বাবার সাথে। ধানমন্ডিতে বেশ সুন্দর বাড়ি ওদের। মায়ের সাথে না যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে 'কিছুটা সময় বাবার সাথে থেকে চলে যাবো মায়ের কাছে। সেখান থেকে বেরিয়ে পড়বো স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে।' শিখার স্বপ্ন দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানো এবং পৃথিবীর সর্বোচ্চ সাতটি পর্বত শৃঙ্গ জয় করা। গতবছর থেকে এইজন্যই ট্রেকিং এর ট্রেনিং নিচ্ছে।

শিখা দুরন্ত। প্রাণশক্তিতে ভরপুর। ভার্সিটিতে খুব পপুলার। কেউ শিখার কাছে হেল্প চেয়ে পায়নি, এমন কখনো হয় নি। ধুপধাপ যখন যা খুশি করে বেড়াচ্ছে। গত বছর ডিপার্টমেন্ট এর পিকনিকে গিয়ে ছেলেদের সাথে জোর করে ফুটবল খেলছে। টানা ৩০ মিনিট খেলে একটা গোল করে তবে

মাঠ ছেড়েছে। একবার ভার্সিটির এক বড়ভাই মাস তিনেক ওর পেছনে ঘুরে খুব সাহস করে বলে ফেলেছিলো, শিখা আমি তোমাকে ভালোবাসি।
সেই প্রেম সপ্তাহখানেক টিকেছিল। কারণ, শিখা তাকে হোটেলে নিয়ে গিয়ে বলেছিলো আসেন প্রেমের শুরক আগে আপনার পারফরমেন্সটা টেস্ট করে ফেলি। সেই লোক পালিয়েছিল্যে তখনি। বুঝতে পেরেছিলো এই মেয়ের সাথে আর যাইহোক প্রেম করা চলে না।

নিলয় স্যারের ব্যাপারটাই ধরা যাক। উনি ভাসিটিতে নতুন জয়েন করেছেন। ভদ্রলোক কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে এসেছেন। বেশ ভালোই পড়ান। স্টুডেন্টরাও উনাকে পচ্ছন্দ করেন। প্রমিত বাংলায় কথা বলেন। উনার ওয়াইফ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। মজার বিষয় হলো উনি যে উনার বৌয়ের ভয়ে সবসময় তটস্থ থাকেন এটা ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে শিখার কারণে। স্যার একবার ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করায় শিখা তাতে লাভরিঅ্যাক্ট দিয়েছিলো। পরিণতি, সন্ধ্যায় স্যার এর কল এবং সনির্বন্ধ অনুরোধ, শিখা যেন আভা ম্যাডামকে (নিলয় স্যারের ওয়াইফ) একটু বুঝিয়ে বলে যে স্যারের সাথে শিখার কোনো লটর পটর নাই। শিয়া কি বলেছিলো জানি না, তবে শিখার প্রতি ম্যাডামের অগ্নিদৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায় সেই আলাপন খুব একটা সুখকর ছিল না। এরপর থেকে স্যার ফেইসবুক ফুল-পাখি কিংবা সবজির ছবি দিয়ে জীবন কত সুন্দর কিংবা তপ্ত দুপুরে মিষ্টি হাওয় টাইপের কোনো পোস্ট দিলেই ওরা বুঝতে পারে আজকে ঘটনা যারাপ। শিযার ধারণা। আসলে ধারণা না. দৃঢ় বিশ্বাস, ম্যাডাম স্যার কে নিয়মিত মারধর করেন। স্যার সর্বক্ষণ এর থেকে পরিত্রানের উপায় খুঁজে বেড়ান এবং সুযোগ পেলেই যেকোনো সময় তার মেয়েকে নিয়ে বিদেশে চলে যাবেন। তাদের তিন জনেরই কানাডার সিটিজেনশিপ নেয়া আছে। এছাড়া ক্লাসের অনেকেই মনে করে স্যার এর তুলনায় ম্যাডাম এর গোফের রেখাটা একটু বেশি পরু।

দুই

দুপুরের দিকে একটু ঘুমিয়েছিলো সোমা। ঘুম থেকে উঠে দেখে তার ফুফা ড্রয়িং রুমে বসে তার বাবার সাথে গল্প করছে। আবুল হায়াৎ পাটোয়ারী
সোমার আপন ফুফা নন। উনি সোমার বাবার ফুফাতো বোনের হাসব্যান্ড। বিস্তর সম্পত্তির মালিক। বিজি প্রেসের একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হয়ে উনি যে পরিমান প্রপাটি করেছেন তা এক বিস্ময়। মোহাম্মদপুরে উনাদের তিনটি ছয়তলা বাড়ি। যার একটিতে সোমারা ভাড়া ছিল প্রায় চার বছর। জিন মাসের ভাড়া বাকি থাকার কারণে এক সন্ধ্যায় এই ফুফা সোমাদের হাসিমুখে বাসা থেকে বের করে দেন। বাবা মা ছোট ভাই সহ সোমাদের ওই রাতটি বাসার বাইরেই কাটাতে হয়েছিল। ভদ্রলোকের আগমনের হেতু বোধহয় মেয়ের বিয়ের দাওয়াত দিতে। মায়ের কাছে শুনছিলো সোমা যে আগামী মাসে রিয়া আপুর বিয়ে। বেশ কয়েক বছর হলো সোমাদের বাসায় আত্মীয় স্বজনের যাতায়াত বেড়ে গেছে। সাহায্য সহযোগিতা ছাড়াও, তসবির কিংবা পারিবারিক অনুষ্ঠানে সোমাদের উপস্থিতি এখন অনেকের জানো সৌভাগ্যের ব্যাপার।

সোমারা এই বাসায় মুড করেছে বছর পাঁচেক হলো। ছয় বেডরুমের প্রায় সাড়ে চার হাজার স্কয়ার ফিটের ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটটি তৈরিতে সোমার বাবা সোবাহান সাহেব প্রচুর খরচ করেছেন। এক একটি বাথরুম এর ফিটিংসের এর পেছনেই খরচ হয়েছে প্রায় চল্লিশ লক্ষ টাকা।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের সহকারী প্রধান প্রকৌশলী আব্দুস সোবাহান তালুকদার ছাত্র জীবনে বাম রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। সোমার নানা মানে সোবাহান সাহেবের বাবা মাওলানা আতামত আলী তালুকদার ছিলেন পেশ ইমাম। এলাকায় তার অত্যন্ত সুখ্যাতি ছিল। তার জন্যেই সোমাদের গ্রামের বাড়ির নাম ইমাম বাড়ি। স্ত্রীর ইচ্ছায় ছেলেকে মাদ্রাসায় না পড়িয়ে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন মাওলানা আজমত আলী। মেধাবী সোবাহান তালুকদার উপজিলা ফার্স্ট হয়ে এসএসসি এবং এইচএসসি তে বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় নবম স্থান অধিকার করে বুয়েটে ভর্তি হন। ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত থাকলেও লেখাপড়ার কোনো ক্ষতি হয়নি। কৃতিত্বের সাথে লেখাপড়া শেষ করে যোগ দেন গণপূর্ত অধিদপ্তরে।
বাবার কড়া নির্দেশ ছিল ঘুষ খাওয়া যাবে না। তাই চাকরি জীবনের প্রথম দিকের বেশ কয়েক বছর অত্যন্ত সৎভাবে জীবন যাপন করেছেন। সোমা, বাবলু স্ত্রী রেহানা কে নিয়ে বেশ সুখেই দিন কাটছিলো তার। এই ছন্দে পতন হলো সরকার দলীয় এক কন্ট্রাক্টরের কাজের মানের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করার কারণে। 

সততার পুরস্কার স্বরূপ এক বিকেলে সাসপেনশন লেটার হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। লোকে বলে বিপদ যখন আসে, সর্বদিক থেকে একসাথে আসে। এটা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন সোবাহান সাহেব। তাঁর বাবার কিডনিতে সমস্যা দেখা দিলো। মিরপুরের কিডনি হসপিটালে প্রায় দুই মাস চিকিৎসার পর মারা যান মাওলানা আজমত আলী। বাবার চিকিৎসায় জমানো টাকা, রেহানার গয়না, সব একসাথে শেষ হয়ে যায়। বাসা ভাড়া বাঁকি পড়লো। পাড়ার দোকানদারগুলোও পাওনা টাকার জন্যে ঘন ঘন সালাম দেয়া শুরু করলো। আত্মীয় স্বজনরা এমুখো ঘেঁষা বন্ধ করে দিলো। পরিস্থিতি এতটাই বদলে গেলো যে আপন ফুফাতো বোনের জামাই, যার বাসায় ভাড়া ছিল, তিনিও তিন মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি পড়ার কারণে বাসা থেকে বের করে দিলো। সোমা-বাবলু কে নিয়ে একেবারে রাস্তায় নেমে আসতে হলো।

সেদিন অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করে চাকরিতে যোগদান করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না সোবহান সাহেবের। তার চাকরিতে যোগদানের পর ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে থাকে সবকিছু। হু হু করে টাকা আসতে থাকে চারিদিক থেকে। টাকার সাথে সাথে আলগা হয়ে যাওয়া পুরোনো সম্পর্কগুলো আবার তাজা হতে শুরু করে। যেই আত্মীয়স্বজন এক সময় এড়িয়ে চলতে চাইতো, তারাই এখন তাঁর সান্নিধ্য পাওয়ার জন্যে মুখিয়ে থাকে। লোভী কুকুরের মতো বসে থাকে বাইরের বারান্দায়, ঘন্টার পর ঘন্টা। থাকবেই না বা কেন! সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সোবাহান সাহেবের হট কানেকশন কারো অজানা নয়। স্বয়ং সচিব মহোদয় তাকে সমীহ করে চলেন। দুদকের হিসেবে তার অবৈধ সম্পত্তির পরিমান প্রায় পাঁচশো কোটি টাকা। আসলে এর চেয়ে কয়েকগুন বেশি টাকা তার দুবাই আর লন্ডনের রিয়েল এস্টেট মার্কেটে ইনভেস্টমেন্ট করা আছে।

এতো কিছুর পরেও অতৃপ্তির একটা বেদনা মাঝে মাঝেই তাকে ছেঁকে ধরে। চারিদিক শুনা মনে হয় তখন। মনে হয় যেন বস্তুবাদী জীবনের পেছনে ছুটতে ছুটতে হারিয়ে ফেলেছেন অনেক কিছু। সোমাকে উনি বুঝতে পারেন না। এতো করে বলার পরেও মেয়েটা বিদেশে পড়তে গেলো না। এমনকি প্রাইভেট ভার্সিটিতেও এডমিশন নিলো না। একদিন ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে এসে বলে, ভর্তি হয়েছি। রেহানা শয্যাশায়ী আজকে প্রায় চার বছর। সপ্তাহে দুই একটা দিন কথাটা হয় রেহানার সাথে। বাবলুটা ঘর ছেড়েছে বহুদিন হলো।

একদিন সরাসরি মুখের উপর বলে দিলো, তোমার আয়ের সাথে বায়, সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তাই চলে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে আসে মায়ের সাথে দেখা করতে। তার সাথে কথা বলে না। ইদানিং কি সব আন্দোলন করছে কোটা সিস্টেম এর বিরুদ্ধে। আসলে সোমা-বাবলু কিংবা রেহানা তাঁর নৈতিক পতন মেনে নিতে পারেনি।

মৃত্যুশয্যায় বাবার কথাগুলো মনে পরে সোবাহান সাহেবের। মারা যাবার আগের দিন দুপুরে শিং মাছের ঝোল দিয়ে ভাত যেতে চাইলেন। রেহানা বাসায় গেছে বাবার জন্যে রান্না করতে। তিনি বসেছিলেন। এমন সময় বাবা কাছে ডাকলেন। বললেন, বাবা আব্দুস সোবাহান, কাছে আসো। জানি তুমি অনেক অর্থকষ্টে আছো। তবে এই অবস্থা বেশিদিন থাকবে না। সামনে তোমার সামনে দুইটা দরজা দেখতে পাবা। একটা ন্যায়ের আর একটা অন্যায়ের। আপাত দৃষ্টিতে অন্যায়ের পথটিকেই খুব মসৃন সহজ মনে হবে। মনে রেখো অন্যায়ের পথ কখনোই তোমাকে তোমার মঞ্জিলে নিতে পারবে না। হারামের উপার্জনে শান্তি নাই বাবা। আমাদের বংশে হারামের রুজি সহ্য হয় না। বাবা মারা যাওয়ার পরে তার কথা আর রাখতে পারেননি সোবাহান সাহেব। তার পরিণতি ভোগ করছেন এখন। সব থেকেও যেন কিছুই নেই।

তিন.

মুহিতের সাথে সোমার পরিচয় খুব অদ্ভুত ভাবে। পাড়ার ছেলে হিসেবে চিনতো কিন্তু কথা হয়নি কোনোদিন। সোমারা এই এলাকায় আসার পরে বাবলুও যোগ দিয়েছিলো ওদের আড্ডায়। অল্প কিছুদিনের ভেতরেই মুষিত যেন ওকে জাদু করে ফেলছিলো। সারাক্ষন শুধু মুহিত ভাই মুহিত ভাই করতো। কিছুদিন আগেও বাথরুমে বাবার রেজার দিয়ে গাল কেটে ফেলা বাবলু একদিন বলে যে,
-
জানিস আপি, রাষ্ট্রের একটা কমপ্লিট রিফর্ম দরকার।
বাবলুর কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সোমা। বলে,
-
যুব ভালো। কিন্তু করবেটা কে? তোর ওই মুহিত ভাই?
-
মুহিত ভাই একা করবে কেন? এদেশের মানুষ করবে। আর কতদিন এই নিপীড়ন মুখ বুঝে সহ্য করবে মানুষ?
-
তোর মাথায় সমাজতন্ত্রের এই পোকা কে চুকাচ্ছে: তোর মুহিত ভাইকে তো পুলিশে দেয়া উচিত। চায়ের দোকানে বসে বসে বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেদের মগজ ধোলাই করছে।
-
নারে আপু তুই জানিস না। মুহিত ভাইয়ের স্যাক্রিফাইস অনেক। ওরা একটা মুভমেন্ট অর্গানাইজ করছে।
চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে দিতে? তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললো সোমা।
মুহিত ভাই বলে
-
সমাজ সংস্কার হলে রাষ্ট্রের সংস্কার এমনিতেই হয়ে যাবে। আর সমাজ সংস্করের জন্যে প্রথমেই দরকার দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। এই দুর্নীতিবাজদের সামাজিক ভাবে বয়কট করতে হবে। এদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আর এই আন্দোলনের শুরুটা করতে হবে নিজের ঘর থেকে।
নিজের ঘর থেকে মানে কি? তুই কি বাবার বিরুদ্ধে c = 1 গান দেয়া শুরু করবি নাকি?
-
বাবলু হাসে। বলে, চার দেয়ালের ভেতরে গান দিয়ে কি হবে? তাছাড়া  োগান প্রতিবাদের একমাত্র ভাষা নয়, অনেক ভাষার মধ্যে একটা। আরো অনেক রকম ভাবে প্রতিবাদ করা যায়।

কয়েক মাসের মধ্যে বাবলু যেন বেশ বড় হয়ে উঠে। ওর আচার আচরণ পাল্টে যেতে থাকে খুব দ্রত। প্রায়ই বাবার সাথে কথা কাটাকাটি হতো। এতো টাকা কোথা থেকে আসে? চাকরি ছাড়া বাবার কি এমন ব্যবসা আছে? বাসায় তিন তিনটা গাড়ি মেইনটেইন করা হয় কিভাবে? ইত্যদি ইত্যাদি। একদিন বাসা ছেড়ে হলে গিয়ে উঠে। সোমা প্রথমে ভেবেছিলো ছেলে মানুষ, রাগ কমলে কিছুদিন পরে এমনিতেই ফিরে আসবে। দুই মাস পেরিয়ে গেলেও যখন আর আসলো না. তখন আর সোমা ধৈর্য্য রাখতে পারলো না। সোজা উত্তের দোকানে গিয়ে মুহিতকে জিজ্ঞাসা করলো,
-
আমার ভাইকে বিপ্লাবী বানিয়ে নিজে তো মহা সুখে আছেন। লজ্জা করে না আপনার: এতটুকু একটা ছেলেকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসলেন। আর নিজে মহাসুখে আড্ডা দিয়ে দেশ উদ্ধার করে চলেছেন।
-
আপনি বসুন। শুনেছি বসলে অর্ধেক রাগ কমে যায়।
-
আমার রাগ কমাতে হবে না। আমার ভাইকে এনেদিন।
-
আপনার ভাইতো অন্য কোথাও যায় নি। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে উঠেছে। আপনিও তো একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন এবং চাইলেই তার সাথে দেখা করতে পারেন।
-
উপদেশ দেবেন না। আমার দেখা আমি করেছি। অনেকভাবে বুঝিয়েছি।
কিন্তু সে কিছুতেই আসবে না।
-
তাহলে কি তাকে জোর করা ঠিক হবে? তার এই বাড়ি ছাড়াকে শিশু সুলভআচরণ ভাবলে ভুল হবে। এটা একটা মুভমেন্ট। অন্যায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন। যার শুরুটা নিজের ঘর থেকে।
-
আমি এতো কিছু বুঝি না। আমার ভাইকে এনেদিন। তাছাড়া নিজেতো ঠিকই বাসায় আছেন। আপনি ঘর ছাড়ছেন না কেন? কেন শুধু বাবলুই স্যাক্রিফাইস করবে?
-
আপনি এখন অনেক উত্তেজিত হয়ে আছেন? বাসায় যান, আর একবার ভাবুন। তারপরেও যদি আপনার মনে হয় বাবলুর ফিরে আসা উচিত, কথা দিচ্ছি আমি নিজে বাবলুর সাথে কথা বলবো।
সোমা তখন বাসায় চলে এলেও মুহিতের ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার জন্যে শিখাকে ফোন দেয়।
-
শিখা আমাদের এলাকায় মুহিত নামে একটা ছেলে আছে। ওর ব্যাপারে কিছু খোঁজ নিয়ে দিতে পারবি?
আরে এটা কোনো ব্যাপারই না। বাবাকে বললেই হবে। কিন্তু কেন বন্ধুঃ প্রেম করবি নাকি:
-
না প্রেম ট্রেম কিছু না। বাবলুকে উল্টাপাল্টা কিসব বুঝিয়েছে। বাবলু বাবার সাথে ঝগড়া করে বাসা ছেড়ে হলে গিয়ে উঠেছে।
-
কুচ পরোয়া নেহি বন্ধু। কালকের মধ্যেই তোর মুহিতের নাড়ি-নক্ষত্র সব জানতে পারবি।
পরদিন সকাল নয়টায় শিযার ফোন। হাপাতে হাপাতে বলে,
-
এই জিনিস তুই কই পেলি সোমা: এতো অনেক কামেল আদমি।
-
মানে? অবাক হয়ে জানতে চায় সোমা।
আরে মুহিত মানে এহসানুল হক মুহিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিলোসোফিতে অনার্স মাস্টার্সএ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছে। শুধু তাই নয় এই ছেলে রেকর্ড মার্কস নিয়ে পাস করার পরেও বিশ্ববিয়ালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়নি। এই কুতুব ফিলোসোফিতে পড়ার সময় তেও ভাবল ডিগ্রি নিয়েছে। যযারীতি এখানেও প্রথম হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল মেয়ের হার্টথ্রব ছিল ও। মুহিতের বাবা বাংলাদেশের প্রথম সারির দশজন

শীর্ষ ব্যবসায়ীর মধ্যে একজন। প্রায় পঞ্চাশ হাজার কর্মচারী কাজ করে ওদের কোম্পানিতে। মুহিতের বড় ভাই বর্তমান সরকারের একজন খুব পাওয়ারফুল মিনিস্টার। আর এক ভাই শিল্পমন্ত্রণালয়ের সচিব। বিগত সরকারেও মুহিতের মামা দুই দুইটা মন্ত্রণালয় একা সামলিয়েছেন। এছাড়াও মুহিতের দাদা শেখ মুজিবর রহমান সাহেবের খুব কাছের লোক ছিলেন। এরা বনেদি ধনী।

তবে অনার্স এর দ্বিতীয় বর্ষে থাকতে বাবা ভাইদের ব্যবসা রাজনীতি সবকিছুতেই অনিয়মের প্রতিবাদ স্বরূপ মুহিত ঘর ছাড়ে। এই ছেলে ভিন্ন কিসিমের পাগল। গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে গিয়ে এরা একটি অন্য ধরণের সমাজ গড়তে চায়। বর্তমান সরকারের বিপক্ষে এতো কিছু লেখার পরেও যে গুম হয়ে যায়নি তার কারণ ওদের পারিবারিক প্রভাব। এই প্রভাব কতদিন ওকে সেফ করতে পারবে কে জানে। গোয়েন্দা রিপোর্টে ওর নাম লাল কালিতে লেখা হয়েছে আরো বছর দুয়েক আগে।

ধীরে ধীরে সোমা জানতে পারে উত্তের দোকানে আড্ডা দেয়া ছেলেগুলো আসলে স্বস্ব ক্ষেত্রে কীর্তিমান। তাদের ভাবনাগুলো যেন সবারই প্রাণের চাওয়া। সবারই বলতে না পারা অব্যক্ত কথা। তাদের কথাগুলো খুব স্পষ্ট। তারা চায় রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। সোমাও মাঝে মাঝে যোগ দেয় ওদের আড্ডায়।

সেদিন আড্ডায় কায়সার বলছিলো, এভাবে মুখ-চোখ-কান ঢেকে রেখে গান্ধীর তিন বাঁদরের মতো দেশ চলতে পারে না। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত যতগুলো সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় এসেছে তারা ভিন্ন মতবাদের হলেও একটি ব্যাপারে সবার মতাদর্শ এক ছিল। তা হলো কাজের সমালোচনা সহ্য করতে না পারা। যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিৎ করে না. সেই সরকার, সেই রাষ্ট্র ব্যর্থ হতে বাধ্য। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্রই হচ্ছে রাষ্ট্রের জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস এবং নির্বাচিত সরকার তার জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি ৭২ পরবর্তী প্রতিটি সরকারই নিজেদের জনগণের মালিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। কোনো সরকারই জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে পারেনি বরং কিভাবে জনবিচ্ছিন্ন হওয়া যায় তারই প্রতিযোগিতা করেছে সবসময়।

উল্টো সমালোচনা এড়ানোর জন্যে রীতিমতো রাষ্ট্রীয়ভাবে বেতনভুক্ত তোষামোদকারী নিয়োগ দিয়ে রেখেছে। যাদের প্রধান একমাত্র কাজ সরকার এর চারিপাশে ঘোরা এবং গুণগান করা। যেন হীরক রাজার দেশ-সাথে যোগ করে বিপ্লব। কায়সার বিপ্লব ওদের আড্ডার নিয়মিত সদস্য। ওরা দুজনে ছেলেবেলার বন্ধু এবং ব্যবসায়ীক পার্টনার। মুহিতের ভাষায় ভেরি রেয়ার কম্বিনেশন। বুয়েট থেকে পাশ করে নিজেরাই একটা স্টার্টআপ দিয়েছিলো। এখন সেটা ফুলে ফেঁপে একাকার।

মুহিতদের আড্ডার একটা ভালো দিক হল ওরা খুব কঠিন কঠিন কথা কিভাবে যেন খুব সহজ ভাষায় বলতে পারে। ওদের ভাবনাগুলো অন্যের মগজে ঢুকিয়ে দিতে পারে অনায়াসে। সোমা নিজেই তার জ্বলন্ত উদাহরণ। পারিপার্শ্বিক অস্থিরতা ওকে খুব একটা বিচলিত করতো না।
ইদানিং সোমাও ভাবতে শুরু করেছে, আসলেইতো আমরা কি স্বাধীন? আমরা কি প্রাণ খুলে কথা বলতে পারি? চারিদিকে কেমন যেন একটা নীরব ভয় সব সময় কাজ করে। এমনকি ফেসবুকে একটা পোস্ট দেয়ার আগে শতবার ভাবতে হয়। যেমন, কিছু বছর আগে সোমাও একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট শেয়ার করেছিল ফেসবুকে। তাই নিয়ে সোমার বাবা সোবাহান সাহেব তার অফিসে বেশ অস্বস্তির মধ্যে পড়েছিলেন।
তিনি কিছু না বললেও, সোমা বেশ বুঝতে পেরেছিলো বাবার অস্থিরতা দেখে।

মুহিত বলে পরাধীনতার প্রথম শৃঙ্খল হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করা। চারপাশে অনেক কিছুই ঘটবে, কিন্তু তুমি কিছু দেখতে পারবে না, বলতে পারবে না, শুনতেও পারবে না। কারণ, তোমার পায়ে অদৃশ্য এক ভীতির শৃঙ্খল পোড়ানো আছে। তুমি টেরই পাবে না যে ঠিক কখন তোমার প্রথমে নাগরিক অধিকার পরে মানবিক অধিকারগুলো কেড়ে নেয়া হয়েছে। পরিস্থিতিই এমনভাবে তৈরী করা থাকবে যে খুব সাধারণ প্রতিবাদ করতেও তোমার বুক ধড়ফড় করবে।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে সঠিক যোগ্য নেতৃত্ব তৈরী হতে না দেয়া। যেমন, ধরো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি। যেখান থেকে জাতীয় নেতৃত্ব তৈরি হওয়ার কথা। ছাত্র রাজনীতির প্রধান উদ্দেশ্য হলো ছাত্রদের ন্যায্য অধকার নিশ্চিত করণের লক্ষে কাজ করে যাওয়া। অধিকার আদায়ে সরব সোচ্চার হওয়া। এছাড়াও জাতীয় প্রয়োজনে জনগণের পাশে থাকা এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই নেতৃত্বের ট্রেনিং নিয়ে পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে অবদান রাখা।

কিন্তু এখন কি হচ্ছে? সরকারি দলের লেজুড় বৃত্তি করতে গিয়ে তরুণ মেধাবী ছাত্ররা কিভাবে ঝরে যাচ্ছে: তারা বুঝতেও পারছে না দেশকে নেতৃত্ব শুণ্য করতে এবং আমৃত্যু নিজেদের আসন পাকাপোক্ত অদক্ষ্য শাসকদল পারিবারিক কোটায় নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে কি বিভৎস্য ধ্বংসের খেলায় মেতেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পর্যন্ত নিজেদের নীল-সাদ্য দলে ভাগ করে নিয়েছে। সাদা দলে নাম লেখানো শিক্ষক যখন নিজ দলের ছাত্রদের অনৈতিক সুবিধা দেয়, তখন সে একটুও ভাবে না অন্য দলের অথবা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে সে কতটা নিচে নেমে যাচ্ছে। পট পরিবর্তনের সাথে সাথে আবার একই কাথের পুনরাবৃত্তি ঘটছে নীল দলের সাথে। দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি বিশেষ বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া এই শিক্ষকরা কিভাবে তার ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তাদের সম্মান আশা করবে: হ্যা, কিছু শিক্ষক আছেন যারা এখনো তাদের নীতি বিসর্জন নীতি বিসর্জন দেননি। কিন্তু তারা সংখ্যায় এতই নগন্য অথবা তাদের আওয়াজ এতটাই ক্ষীণ যে. জাতি তাদের দেখতেও পায় না, শুনতেও পায় না।

এই নীতি বিবর্জিত শিক্ষকদের দলে ভেড়ার পালের মতো যোগ দিচ্ছে কবি-সাহিত্যিক, চাটুকার সাংবাদিক সহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। ফ্যাসিস্টতন্ত্র কায়েম করার জন্যে জাতির বিবেককে মেরে ফেলতে হয়। তাতে সাধারণ মানুষ অন্যায়কে অন্যায় বলতে ভুলে যায়। রাষ্ট্রীয় যেকোনো শোষণ নির্ধিধায় মেনে নেয়। একনায়ক ফ্যাসিস্টদের ক্ষমতার গদিটা তখন পোক্ত হয়। অনেকটা সত্যজিৎ রায়ের 'হীরক রাজার দেশে ভরিতে খনিতে কাজ করা শ্রমিকের মতো। দেশে এখন যে অবস্থা চলছে এটাকে ফ্যাসিজমের চূড়ান্তরূপ বলা যায়।

শেখ হাসিনা বিগত দশবছরে অত্যন্ত দক্ষ হাতে ফ্যাসিজমকে আধুনিকায়ন করেছেন। এককভাবে কুক্ষিগত করেছেন সকল ক্ষমতা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সর্বপ্রধান নিয়ামক ভোট', সেটিকেও করায়ত্ত করেছেন নির্লজ্জভাবে। শুধু তাই নয় এই নিয়ে কারো টু শব্দটিও তিনি সহ্য করছেন না। গৃহপালিত বিরোধী দল তৈরী করেছেন। রীতিমতো উৎসব করে লুটপটি চালাচ্ছেন তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে। এই মুহূর্তে তিনি নিজেকে অধিষ্টিত করেছেন ভগবানের পর্যায়ে। কিন্তু এভাবে আর চলতে পারে না। দেশে আর একটি অভ্যুত্থান অত্যাসন্ন এটুকু বলে একটু ধামে মুহিত। মুগ্ধ হয়ে মুহিতের কথা শোনে সোমা। কিন্তু শেখ হাসিনার বিকল্প কে?

সোমার এই কথার জবাবে মুহিত বলে, ফ্যাসিজমের এর একটি ধারা হচ্ছে জনগণের মাথায় ভোজে ঢুকিয়ে দেয়া, আমি ছাড়া তোমাদের আর কে আছে? আমাদের প্রথাগত রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে সোমা। আওয়ামীলীগের সাথে জাতীয় পার্টি কিংবা বিএনপি এর সাথে জামাত জোট এরাই বাংলাদেশের আঠারো কোটি মানুষের একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী নয়। নিশ্চয় আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে দেশ গড়ার কাজে। 'রাজনীতি ভালো লোকেরা করে না, এই ধারণা ভাঙতে হবে। রাজনীতি ভালো লোকেরা করে না বলেই খারাপ মানুষেরা সেই স্থান পূরণ করে নেয়। আমি আর তুমি ভালো মানুষ হয়ে তখন ওই খারাপ মানুষগুলোর অধীনেই কাজ করতে কোনো আপত্তি করি না। কিছু দিনের মধ্যেই আমরাও খারাপ মানুষ হয়ে যাই। আমরা এই শৃঙ্খলটাই ভাংতে চাই।

আর এটা তখনি সম্ভব হবে যখন আপামর জনসাধারণ এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করবে। আমাদেরকে তৈরি থাকতে হবে সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্যে। তবেই আমরা অমানিশার এই অন্ধকার হটিয়ে একটি নতুন সূর্যোদয়, একটি নতুন ভোর দেখতে পাব।

মজার ব্যাপার লক্ষ্য করেছো, ৯১ পরবর্তী সকল সরকারের শাসনামলে যতদিন সত্যিকারের বিরোধী দল ছিল, অনাসব ব্যাপারে মতবিরোধ থাকলেও একটি ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোনো ভিন্নমত ছিল না। আর তাহলো শুল্কমুক্ত গাড়ী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে দুইদল সাদা নীল। অন্যসব ব্যাপারে মারামারি করলেও, তারাও একটি বিষয়ে একমত। তাহলো সান্ধাকালীন বাণিজ্যিক ক্লাস বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নেয়ার সুযোগ। কি অবস্থায় আছে দেশ, চিন্তা করা যায়?

চার.

বেশ কিছুদিন ধরে যে কোটা বিরোধী যে আন্দোলন চলছিল তা ধীরে ধীরে আরো ঘনীভূত হচ্ছে। বাবলুর জন্যে খুব চিন্তা হচ্ছে সোমার। টিএসসিতে মাধায় পতাকা বেঁধে বাবলুকে প্রায় দেখা যাচ্ছে আন্দোলনের অগ্রভাগে। হাসিমুখে সাক্ষাৎকার দিচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলোতে। মা খুব দুশ্চিন্তা করছে বাবলুর জন্যে। গত সপ্তাহে ক্লাসে যাওয়া হয়নি। শিখা গিয়েছিলো কিনা জানতে ফোন দিলো সোমা।
-
হ্যালো শিখা?
-
হ্যালো সোমা। আমি বাইরে একটু জোরে বল।
-
তুই কি লাস্ট উইকে ক্লাস গিয়েছিলি?
-
নাহ্। ক্লাস হচ্ছে নাতো। তুই কই?
-
আমি বাসায়। তুই?
-
আমি টিএসসি তে কোটা বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছি।
তুই কোটা বিরোধী আন্দোলনে গিয়ে কি করছিস? তুই কি বিসিএস বসবি নাকি?
-
আরে ধুর! আমিতো বাইরে চলে যাচ্ছি ভাইয়া আর মার কাছে। তবে যাবার আগে ছাত্রদের ন্যায্য দাবির পক্ষে নিজের অবস্থান জানান দিয়ে যাচ্ছি। এটলিস্ট নিজের বিবেকের কাছে ক্লিয়ার থাকতে চাই। বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোকে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলছে। এই অবস্থায় কিভাবে ঘরে বসে থাকি বল?
-
আঙ্কেল তোকে আসতে দিলো?
-
আরে না, আসতে দিতে চায়নি। রীতিমতো পুলিশ পাহারা দিয়ে রেখেছিলো যাতে আমি বাইরে বের হতে না পারি। কিন্তু আমাকে তো চেনে না। এমন টাইট দিয়েছি যে আগামী সাতদিন বিছানা থেকে উঠতে পারবে না।
-
কি করেছিস তুই? আতংকিত হয়ে জিজ্ঞেস করে সোমা।
-
দুই দিন ধরে তক্কে তত্ত্বে ছিলাম। আজ সুযোগ বুঝে খাবারের সাথে উৎমধঃরড়হ ঈৎড়ঃড়হ মিশিয়ে দিয়েছি। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই টয়লেটের সাথে একদম ডাইরেক্ট কানেকশন। একেবারে ছেড়াবেড়া অবস্থা। এটা আমার ছাত্র হত্যার প্রতিবাদ।
-
কি মিশিয়েছিস?
-
চৎধঃরড়হ দিৎড়ঃড়হ- যাঁটি বাংলায় যাকে বলে জামাল গোটা'
-
বলিস কি: আছেলে কেমন আছে?
-
ভালো না। বাবার একই অবস্থা। ফোন দিয়েছিলাম। হসপিটালে ভর্তি হয়েছে। গলা দিয়ে স্বর বের হয় না। কু কু করছিলো।
-
তুই পারিস ! শোন, বাবলুও যোগ দিয়েছে ওই আন্দোলনে।
-
হা দেখলাম তো। আজকেও দেখা হয়েছে।
-
আমার ফোন ধরছে না। দেখা হলে বলিস মা খুব দুশ্চিন্তা করছে। বাসায় আসতে বলেছে।
-
বলবো। তবে মনে হয়না আসবে এখন। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। পুলিশ আগে থেকেই সরকারি বাহিনীর মতো আচরণ করছে। গতকাল কাদের কাক্কু (ওবায়দুল কাদের। ছাত্রলীগকে ওপেন লাইসেন্স দিয়েছে সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের উপর এট্যাক করার জন্যে। কুকুরগুলো এখন হামলে পড়েছে আমাদের উপর।
-
কি বলিস?
-
কালকে রোকেয়া হলে, ইডেন কলেজে ছাত্রীদের উপর এট্যাক হয়েছে, টিভিতে দেখিস নি? আচ্ছা শোন, মুহিত ভাই কইরে! উনাকে একটু সাবধানে থাকতে বলিস। পরশু বাবাকে কার সাথে যেন কথা বলতে শুনলাম। কিসব যেন লিস্ট বানানো হচ্ছে। মুহিত ভাই, কায়সার ভাই, বিপ্লব ভাই সবার নাম আছে ওই লিস্টে। আরো কিছু ইয়ং ছেলে পেলের নাম শুনলাম। মুহিত ভাইয়ের ভাই বোধহয় এইবার খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না। সরকার অনেক বেকায়দায় আছে।
-
আচ্ছা বলবো।
শিখার সাথে কথা শেষ করে সোমা বাবার ঘরে গেলো। দুইদিন ধরে বাবা অফিস যাচ্ছে না। কোনো সমস্যা হলো নাকি?
-
কিছু বলবি মা?
-
অফিস যাচ্ছো না যে? কোনো অসুবিধা: শরীর খারাপ?
-
না এমনিতেই। শরীরটা খুব একটা ভালো না। বাবলুর জন্যে খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। দেশের অবস্থা ভালো না। যেকোনো সময় একটা খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে।
-
আমার ফোনও ধরছে না। চিন্তা করো না বাবা। বাবলু কে আমি শিখাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছি। বলেছি মার শরীর খারাপ। বাসায় আসতে।
-
ভালো করেছিস মা। আমার কথা বললে তো আর আসবে না: ওকে আমি দোষ দেই না। আমার রক্ত ওর শরীরে। অন্যায়ের প্রতিবাদ তো করবেই। আমি হয়তো পচে গেছি কিন্তু আমার রক্ত ঠিকই দাঁড়িয়ে গেছে। ওর জন্য আমার গর্ব হয় মা।

জুলাইয়ের শুরু থেকেই পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে। ছাত্র আন্দোলন যেন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এদিক দিয়ে আওয়ামীলীগ নেতারা ইচ্ছেমতো বিবেক বর্জিত বক্তব্য দিয়েই চলেছেন। আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একটা জাতীয় কার্টুন পরিণত হয়েছেন। এই লোকটা নাকি একসময় ছাত্র রাজনীতি করতো। ১১দফা আন্দোলনের সক্রিয় নেতা ওবায়দুল কাদের জেলে থাকা অবস্থায় ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিল। সময়ের কি অদ্ভুত খেলা। এক সময়ে জুলুমের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা কণ্ঠ নিজেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠের টুটি চেপে ধরছেন। শেখ হাসিনা নিজেও বোধহয় জানেন না তিনি কি করছেন।

চারপাশে এতো চাটুকার: সালমান এফ রহমান, আরাফাত, হাসান মাহমুদ, আসাদুজ্জামান কামাল দিয়ে ঘিরে আছেন সব সময়। সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে এরাই প্রধান অন্তরায়। তিনি বোধহয় জানতেও পারেননি ঠিক কখন তিনি ডজনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন: উমার বাবার ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই ঘটেছিলো। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্যে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত, ত্যাগী নেতাদের নিষ্ক্রয় করে রাখা, চাটুকারদের কাছে টেনে নেয়া নিজ পরিবারের সদস্যদের লাগাম টেনে ধরতে না পারা। তাকে জানবিচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো। তাঁর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা দুই বছরের মধ্যে তলানিতে এসে ঠেকেছিল। পরিনাম ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫।

দিনের পর দিন দেশের অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীদেরও আন্দোলনের মাঠে দেখা যাচ্ছে এবার। সরকার এই আন্দোলন খুব সহজে দমাতে পারবে বলে মনে হয় না। গোটা সরকারে কি এমন কেউ নাই যে. এদের সাথে কথা বলে, এদের ন্যায্য দাবিগুলো নিয়ে শেখ হাসিনার সাথে কথা বলতে পারে?

১৬ জুলাই ২০২৪। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সায়ীদকে নিখুঁত নিশানায় গুলি করে মেরে ফেললো পুলিশ। গোটা জাতি প্রত্যক্ষ করলো কিভাবে নিরস্ত্র ২৩ বছরের যুবককে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি চালিয়ে হত্যা করলো রাষ্ট্রীয় বাহিনী। এই হত্যাকান্ড মেনে নিতে পারেনি সারাদেশের মানুষ। প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে গোটা দেশের মানুষ। সরকার পুলিশ তারদলীয় হেলমেট বাহিনীকে সয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে নামিয়ে দিলো আন্দোলন প্রতিহত করতে। ফেসবুকের কল্যানে বিভিন্ন এলাকা থেকে হেলমেট বাহিনীর নিরীহ জনতার উপরে আক্রমণের ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে যদিও বেশিরভার সংবাদ মাধ্যম শুধু আন্দোলনকারীদের জ্বালাও পোড়াও এর খবর প্রকাশ করছে।

হঠাৎ করে ১৮ তারিখ থেকে করে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। কারো সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় নেই। মোবাইল
নেটওয়ার্কেও ঘের ঘের আওয়াজ হয়। ঠিক মতো কথা শোনা যায় না। ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো এক রাতের মধ্যেই খালি করার নির্দেশ এসেছে। ডিসি, প্রক্টর সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অভিভাবকগুলোর মাথায় মাধায় কি কি আসলোনা যে এই দুর্যোগের মধ্যে এই রাতের বেলা এই ছেলে মেয়েগুলো বাসায় ফিরবে কি করে? গত কয়েকদিন ধরে বাবলুর কোনো খবর নেই। মা খুবই দুশ্চিন্তা করছেন।

রাত থেকে আন্দোলকারীদের দমাতে, তাদের উপর সাঁড়াশি আক্রমণ চললো। চারিদিকে শুধু গুলির আওয়াজ। বিচ্ছিন্নভাবে যে খবর পাওয়া যাচ্ছিলো তা ভয়াবহ। যেন চারিদিকে মৃত্যুর মিছিল। এই ভয়াবহতা উপেক্ষা করেই যাবার পানি হাতে সাধারণ মা বোনদের রাস্তায় নেমে আসতে দেখা গেলো। সোমার মনে পড়লো মুহিত এর কথা। মুহিত বলেছিলো আন্দোলনে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এলে তখনই তা গণঅভুযানে রূপ নেবে। আর গণ-অভ্যুত্থান বন্দুকের নলের কাছে নোটি স্বীকার করে না। কোনো স্বৈর শাসকের পক্ষেই গণ-অভ্যুত্থান ধামানো সম্ভব না।

১৮ থেকে ২৩ জুলাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদ অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় পুলিশ দলীয় কর্মীদেরদ্বারা কয়েকশো নিরীহ মানুষকে মেরে ফেললো। স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করলো একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। রাস্তায় রাস্তায় লাশ পরে থাকতে দেখা গেলো। কি বিভৎস্য সেই দৃশ্য।

মুহিতের সাথে কথা হয়না বেশ কিছুদিন। শিখার কথাও মুহিতকে বলা হয় নি এখনো। ওকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না কয়েকদিন ধরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা কে দেখা গেলো ছাত্রদের পক্ষে মাঠে নেমেছেন। সব চেনা মুখ। যেকনো জাতীয় বিপর্যয়ে শুধু এদেরই দেখা যায়। এনারাও বয়োবৃদ্ধ হতে চলেছেন। এনারা চলে গেলে কে আসবেন ছাত্রদের পক্ষে কথা বলতে: মুহাম্মদ জাফর ইকবাল তার চিরচেনা রূপে আবার আবির্ভাব হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রদের হত্যা নিয়ে তার তেমন দুশ্চিন্তা না হলেও তিনি শেখ হাসিনার উগরে দেয়া গালির প্রতিবাদে ছাত্রদের তুই কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার গোন একদমই মেনে নিতে পারেন নি। হাতে লেখা ছোট্ট একটা চিঠি কবি তুলে (কয়েকটি বানা ভুলসহ) ফেসবুকে পোস্ট করেছেন দ্বিতীয় মেয়াদে গর্তে ঢোকা এই প্রফেসর।

নিলয় স্যার কে দেখা গেলো একদিন নীল দলের ঝান্ডা হাতে গণমানুষের এই স্বতস্ফূর্ত আন্দোলনকে বিএনপি জামাতের দুষ্কর্ম আখ্যা দিয়ে ব্যানার হাতে ভার্সিটির গেট দাঁড়িয়ে আছে সমগোত্রীয় আরো কিছু শিক্ষক নামের কুলাঙ্গারের সাথে।

শিখা বলছিলো এই লোক নাকি একটি বিশেষ কোটায় চাকরি পেয়েছে। হয়তো তারই প্রতিদান দিচ্ছে এখন। সন্তানসম ছাত্রদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে তাদের এই নষ্টামো দেখে মনে হয় মুহিত ঠিকই বলেছিলো, দেশের শিক্ষিত শ্রেণী পচে গেছে।
সোমা ঘরে বসেছিল। বারান্দায় যাওয়া যাচ্ছে না। পরশুদিনও একটি বাচ্চা ছেলে বারান্দাতে গুলি যেয়ে মারা গেছে। একটি অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসছে কিছুক্ষন থেকে। সোমা ধরবে না ধরবে না করেও ফোনটা ধরলো। ওপাশ থেকে মুহিতের গলা।
-
সোমা কেমন আছো?
ভালো, কিন্তু তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? তুমি ঠিক আছোতো
মুহিত: আর এটা কার ফোন নম্বর?
-
হ্যা আমি ভালো আছি। এটা আমার নম্বর নয়। তুমি কিন্তু ভুলেও এখানে কল করো না।
থ্যাংক গড। শোনো শিখা বলছিলো কিসব যেন লিস্ট হচ্ছে: তোমার নাম ওখানে আছে, একটু সাবধানে থাকতে। কি হলো কথা বলছো না কেন?
-
সোমা, একটি খারাপ খবর আছে?
-
কি হয়েছে বোলো না:
হঠাৎ করে পাথরের মত কি যেন একটা চেপে বসলো সোমার বুকে। যেন নিঃশাস বন্ধ হয়ে আসছে। তাহলে কি বাবলুর কিছু হলো: ঠিক আছে তো
-
বাবলু কোথায়: বাবলু কেমন আছে মুহিত?
-
শত্রু হও সোমা। বাবলু দেশের জন্যে শহীদ হয়েছে। খুব কাছ থেকে ছোড়া পুলিশের গুলিতে একটু আগে বাবলু মারা গেছে।
সোমার কাছে মনে হলো হটাৎ করেই যেন পুরো পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেলো। তারপরে বেশ কয়েক মুহূর্তে নীরবতা। মুহিতের কাছে যেন মনে হলো অনন্তকাল। নীরবতা ভেঙে সোমাই খুব ঠান্ডা মাথায় জানতে চাইলো
-
বাবলু এখন কোথায় আছে?
-
ঢাকা মেডিকেল এর মর্গে।
ধীর পায়ে সোমা বাবার ঘরে প্রবেশ করে। ওর সোমার কাছে মনে মনে হলো যেন একজন পাথরের মূর্তি বসে আছে।
-
বাবা! বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো সোমা।
-
আমি শুনেছি। যাও মা. তোমার মায়ের কাছে বলে এস।

পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা কিভাবে কাটলো সোমা জানে না। মীরপুর কবরস্থানে বাবলু কে দাফন করা হলো। বাবলুর বুক থেকে তিনটি রাইফেলের গুলি বের করা হয়েছিল। এছাড়াও বুকে পিঠে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া শটগানের গুলি গুলো আর বের করা সম্ভব হয়নি। ওই অবস্থায় বাবলুকে দাফন করা হয়।

পরিশিষ্ট

জাতিকে অবাক করে দিয়ে শেখ হাসিনা ২৫ জুলাই মেট্রোরেল পরিদর্শনে গিয়ে অঝোরে কান্নাকাটি করলেন। জাতি পরিচিত হলো সভা সমাজের এক মডার্ন ডাইনির সাথে। যিনি দেশের স্থাপনা ক্ষতিকে পাঁচ শতাধিক মানুষের জীবনেও থেকেও বেশি মূল্যবান মনে করেছেন। নুতন এই ডাইনির সাথে সাথে কাঁদলেন আরো কিছু চাটুকার।

শহীদুল্লাহ কায়সার এর মেয়ে শমী কায়সারকে দেখা গেলো দলবল নিয়ে বিটিভি ভবন পরিদর্শন করতে এবং শেষে একইভাবে কান্নাকাটি করতে। টেলিভিশনের টকশোতেও কয়েকজনকে কান্নাকাটি করতে দেখাগেলো সেতু ভবনও টোলপ্লাজোয় আগুন দেখে। দেশে শুরু হয়ে গেলো কান্নার রোল। কে কত বেশি কাঁদতে পারে এবং সেই ভিডিও করে ফেইসবুক পোস্ট দিতে পারে। কুমড়ো পটাশ আরাফাত টকশোতে এসে বলতে লাগলো আন্দোলনে যারা গুলি খেয়েছে তাদের বেশিরভাগই মাদকাসক্ত। তা নাহলে কেউ পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক পেতে দাঁড়ায় না। এই ছাগলটাকে কে বোঝাবে দেশপ্রেমই একটা বড় নেশা। পুলিশের বন্দুকের সামনে দাঁড়াতে এই নেশাই যথেষ্ট। অন্য কোনো মাদক লাগে না। ভাবতে অবাক লাগে যে, ৩৩০ সংসদ সদস্যের একজনও এই নৃশংস এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করলো না।

পুত্রশোক সইতে পারেন নি সোমার মা। উনি মারা যান বাবলুকে কবর দেয়ার দুই দিন পরেই। ৩০ সে জুলাই। তিন তারিখে মুহিতের খোঁজে পুলিশ এসেছিলো সোমাদের বাসায়। ৭১ এর ২৫ সে মার্চের মতো পুলিশ বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে জানতে চাচ্ছিলো কোথাও করো ছাত্র লুকিয়ে আছে কিনা? কায়সার ভাই ফোন করে পরে জানিয়েছিল মুহিত পুলিশের হাতে ধরা পরে তারিখ দুপুরে। মুহিতের ভাই বাবা অনেক চেষ্টা করে ছিলেন। কিন্তু কাজ হয়নি। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে সেই রাতেই হত্যা করা হয় মুহিতকে। মুহিতের লাশও পাওয়া যায়নি।

তারিখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার আগে শেষ হত্যাযজ্ঞ চালায়। এক রাতেই হত্যা করা হয় তিনশোরও অধিক নিরস্ত্র-নিরীহ মানুষকে। কায়সার ভাইদের অফিসেও বেশ ভাঙচুর হয়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হসপিটালে নেয়ার সময় রিকশাতেই মারা যান বিপ্লব ভাই। সব মিলিয়ে হাজারের উপরে নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। বাদ যায়নি পাঁচ বছরের শিশু থেকে ৮০ বছরের বুড়ো পর্যন্ত। কয়েক হাজার আহত হয়ে হসপিটালে। যার মধ্যে অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন।

শিখা হসপিটালে। গুলি লেগেছিলো পায়ে। বাঁ পা টা কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। শিখা কল করেছিল গতকাল। বললো,
-
জানিস সোমা, নিলয় স্যার কানাডা চলে গিয়েছে। আমি বলেছিলাম না ভাগবে: কানাডা গিয়ে হারামিটা আবার ফেইসবুক পোস্ট দিয়েছে যে শিক্ষক নিপীড়ণের প্রতিবাদস্বরূপ চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়ে তিনি দেশ ছেড়েছেন। কত বড় ভন্ড, চিন্তা কর।
-
দেখেছি বললো সোমা।
-
সোমা সবাইতো আমাকে দেখতে এলো। তুইতো আসলি না?
-
আসবো শিখা।
-
জানি, আমাকে হুইল চেয়ারে দেখতে তোর কষ্ট হবে। তাই আসছিস না। আঙ্কেল কে নাকি পুলিশ এরেস্ট করেছে?
-
হ্যা।
-
কিন্তু কেন?
-
ঘুষ দুর্নীতির জন্যে।
-
শোন, চিন্তা করিস না। আমার বাবাও কট খেয়েছে। বাছাধনেরা এইবার
বুঝবে কত ধানে কত চাল!
-
এইসব কথা শুনতে ভালো লাগছে না শিখা।
-
মুহিত ভাইয়ের কথা আমি শুনেছি। আসলে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আগে যেকেই রিপোর্ট ছিল যে চলমান এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড মুহিত। মুহিত ভাই অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। জন্মেছিলেন শুধু অন্যের জন্যেই। তুই তো খুব একা হয়ে গেলি সোমা?
রাখি শিখা। পরে কথা হবে।

আর একটু কথা বল। বিছানায় শুয়ে থাকি তো ভালো লাগে না। আমার আর পাহাড়ে যাওয়া হলো না সোমা।
এই প্রথম সোমার মনে হলো শিখা কাঁদছে। শিখাকেও কখনো কাঁদতে দেখেনি। কিছু না বলে সোমা আস্তে করে ফোনটা রেখে দিলো। নিলয় স্যার এর পোস্টটি সোমা দেখেছিলো। তার জন্যে একটা রিপ্লাই লিখেছিলো।

আপনার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্যে বোধোদয় হয়েছে দেখে খুশি হলাম। আশা করি পট পরিবর্তনের সাথে সাথে এই বোধোদয় ডুবে যাবে না, জাগ্রত থাকবে আমৃত্যু। আপনি ভালো পড়াতেন সন্দেহ নেই। তাইতো অল্প কিছুদিনের ভেতরেই আপনি আমাদের কাছে অনেক প্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠেছিলেন। তবে ভাবতে অবাক লাগে, আপনার পদত্যাগের কারণ শুধু৫ তারিখ পরবর্তী শিক্ষক নিপীড়ন। আপনার ছাত্র বাবলুর শরীরের ১৬০ টি ছিদ্র কি আপনাকে মর্মাহত করেনি: বাবার সাথে ছাদে খেলতে থাকা পাঁচ বছরের প্রিয়ার বুক এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাওয়া কি আপনাকে ব্যষিত করেনি? ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ১৭ বছরের ফারহান ফাইয়াজ এর সাদা শার্টের উপর রক্তে ভেজা লাল বুকটি, দেখেও কি আপনার মনে কাঁপন ধরে নি! হাজারের উপরে মানুষ মারা গেলো, তাতেও আপনি নির্বিকার রইলেন। কয়েক হাজার আহত হয়ে হাসপাতালে, তাতেও আপনার মুখে রা নেই। নিজ দলের কিছু শিক্ষককে নাজেহাল হতে হলো, তাতেই আপনার পরমাত্মায় যা লেগে গেলো: বড়োই অদ্ভুত!! শিক্ষক হিসেবে আপনি মহান। শুধু ছোট্ট একটি অনুরোধ করি, জীবনে আর যাই করেন, শিক্ষকতা করবেন না। ওখানে আপনাকে মানায় না।

পরে আর পোস্ট করা হয়নি। কি হবে করে? ইদানিং রাতে আর ঘুম হয় না। অনেকদিন পরে সোমা কফি হাতে বারান্দায় বসলো। সামনের মসজিদ থেকে ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে। মুসুল্লিরা একে একে হেটে মসজিদের দিকে যাচ্ছেন। দেখতে ভালো লাগছে। বাবা আগে প্রতি শুক্রবারে বাবলুকে নিয়ে মসজিদে যেতেন। বাবলুটা পাঞ্জাবি পায়জামা পড়তে চাইতো না। মা জোর করে পরিয়ে দিয়ে মাথায় টুপি দিয়ে দিতেন। বাবলুর কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চক্ষের কোনায় জল চলে এসেছিলো বুঝতে পারেনি সোমা। আস্তে আস্তে চারিদিকে আলো ফুটতে শুরু করেছে। মুসুল্লিরা নামাজ শেষে ফিরছেন। সামনের উত্তের দোকানিও দোকান খোলার তোড়জোড় শুরু করেছে। এই মুহূর্তে সামনের অংশটা ঝড় দিচ্ছে। আচ্ছা মুহিত কি এমন একটি নতুন সূর্যোদয় দেখতে চেয়েছিলো: এমন একটি ভোরের জন্যই কি অপেক্ষা করেছিল।

লেখক: শেখ শুভ

 

 

এনএম/ধ্রুবকন্ঠ


ধ্রুবকন্ঠ | Dhruba Kantho

“তারুণ্যের সংবাদ মাধ্যম”

কপিরাইট © ২০২৫ ধ্রুবকন্ঠ | Dhruba Kantho । সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত