সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪ কে অন্তর্ভূক্তিমূলক ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতির আলোকে ঢেলে সাজানোর আহ্বান
বিতর্কিত সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট ও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিলের মাধ্যমে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪- প্রনয়ন করার জন্য এবং মত-প্রকাশের সাথে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ আইনটিকে অগ্রাধিকার দেয়ার উদ্যেগকে জাতীয় নাগরিক কমিটি স্বাগত জানাই। তবে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশটির ব্যাপ্তি, উদ্দেশ্য এবং অপব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ তার পূর্বসূরি আইনসমূহ, যেমন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন,২০০৬, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮, (ডিএসএ) এবং সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ (সিএসএ) থেকে পুরনো এবং ঔপনিবেশিক যুগের ধারণাগুলিকে উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। কম্পিউটার-সংক্রান্ত অপরাধ এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোকে মতপ্রকাশ-সংক্রান্ত অপরাধের সঙ্গে একত্রিত করার মাধ্যমে, এই অধ্যাদেশটি মূলত অনলাইন জগতের ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে যা আইনের উদ্দেশ্যকে দুর্বল এবং অস্পষ্ট করে তোলে। এছাড়াও, সাইবার স্পেসের ব্যাপক সংজ্ঞা—যাতে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, ব্লকচেইন, ক্লাউড এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মতো প্রযুক্তিগুলোর অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। যেহেতু এই ধরনের প্রযুক্তি স্বতন্ত্র ক্ষেত্রে পরিচালিত হয় এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে বিশেষায়িত নিয়ন্ত্রক পদ্ধতির প্রয়োজন হয়, তাই প্রায়োগিক দিক থেকে এ ধরনের প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তি আইনকে বিস্তৃত করে তোলে এবং যথাযথ বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।
বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হল “ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধ” এবং “অশ্লীল” এর মতো শব্দগুলোর অন্তর্ভুক্তি, যা ঔপনিবেশিক যুগের দণ্ডবিধি, ১৮৬০ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত আপেক্ষিক (subjective) নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মান দ্বারা প্রভাবিত। এই শব্দগুলো বিস্তৃত এবং ব্যক্তিপর্যায়ের ব্যাখ্যার সুযোগ দেয়, যা ধারাগুলোর অপব্যবহারের পথ সুগম করে। এছাড়াও অধ্যাদেশে ব্যবহৃত, “শৈল্পিক” বা “শিক্ষাগত মূল্য” সম্পর্কিত অস্পষ্ট ভাষা কার্টুনিস্ট, শিল্পী এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা জন্য কাজ করা এক্টিভিস্টদের জন্য একটি বড় হুমকি তৈরি করে, যা সৃজনশীলতা, ভিন্নমত প্রকাশ এবং গঠনমূলক সমালোচনাকে দমন করতে পারে।
বহু বছরের সমালোচনার পরও, খসড়া অধ্যাদেশের ৮ ধারায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) দায়িত্বের সঙ্গে একত্রিত করে জাতীয় সাইবার সুরক্ষা সংস্থার মহাপরিচালককে (ডিজি) অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। ডিজি “অখণ্ডতা, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন” হওয়ার মতো অস্পষ্ট ভিত্তিতে বিষয়বস্তু ব্লক বা অপসারণের অনুরোধ করতে পারেন। এ শব্দগুলোর কোন স্পষ্ট সংজ্ঞা না থাকায় তা স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত এবং সম্ভাব্য অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করে। এছাড়াও তথ্য ব্লক বা অপসারণ করার ক্ষেত্রে অধ্যাদেশটি একটি স্বাধীন তদারকি ব্যবস্থার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছে, যা ডিজি’র উক্ত ব্লক বা অপসারণ করার ক্ষমতাকে একচ্ছত্র এবং অস্বচ্ছ করে তোলে।
আরও উদ্বেগজনক হলো, খসড়া অধ্যাদেশের একাধিক ধারায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি কেবল মাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে তল্লাশী পরোয়ানা ছাড়া যে কোনো স্থানে প্রবেশ এবং তল্লাশির ক্ষমতা রয়েছে। সেইসাথে, আইন প্রয়োগকারী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলি যেকোনো সংস্থা ব্যবহারকারীর কাছ থেকে ট্রানজিট ডেটাসহ যেকোনো তথ্য চাওয়ার ক্ষমতা রাখে। এই বিধানগুলো সংবিধান দ্বারা প্রদত্ত গোপনীয়তার অধিকারের লঙ্ঘন করে, একই সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলিকে ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করে, যারা অতীতেও এ আইনের অধীনে ক্ষমতার অপব্যবহারের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে।
সরকারের প্রতি আমাদের এ আহ্বান জানাই যে, খসড়াটি পুনর্বিবেচনা করে এটিকে একটি স্বচ্ছ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক জনপরামর্শ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইন প্রনয়ন করা উচিত, যাতে বিভিন্ন অংশীজন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত এ আইনে প্রতিফলিত হয়। অধ্যাদেশ প্রণয়নে নিযুক্ত পরামর্শকদের পরিচয় ও যোগ্যতা প্রকাশ করা উচিত, যাতে জনসাধারণের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় অগ্রাধিকার দিয়ে আন্তর্জাতিক সনদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিধান আইনে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
তার পাশাপশি সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪-এ গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতির যাতে যথাযথ প্রতিফলন ঘটে তা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করার জোর দাবী জানাচ্ছি সরকারকে। এটিও উল্লেখযোগ্য যে, সরকার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত ডিএসএ বা সিএসএর অধীনে কোনো মামলাকে বাতিল বা নিষ্পত্তি করা হয়নি, এবং ভুক্তভোগীরা আজও এ আইনের বিধানের ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। এই উদ্বেগগুলো অবিলম্বে সমাধান করতে ব্যর্থ হলে সেন্সরশিপের সংস্কৃতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, এবং মৌলিক স্বাধীনতার লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে এবং এটি জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে সম্মান করতে ব্যর্থ হবে বলে জাতীয় নাগরিক কমিটি মনে করে।
বার্তা প্রেরক
সামান্তা শারমিন
মুখপাত্র
জাতীয় নাগরিক কমিটি