শিক্ষা

পাঠ্যবই : আর কত দেরি এনসিটিবি?

ফেব্রুয়ারির পাঁচ দিন চলে গেলেও প্রথম থেকে দশম শ্রেণির অনেক শিক্ষার্থী এখনো বই পায়নি। এনসিটিবি-র দাবি, ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সব শিক্ষার্থী বই পাবে। তবে প্রকাশকরা বলছেন, তা সম্ভব নয়৷
তাদের মতে, বিষয়টি নির্ভর করছে অন্তত তিনটি শর্তের ওপর ; ১. যদি ব্যাংক ঋণ ঠিকমতো পাওয়া যায়। ২. যদি কাগজ কথামাতো পাওয়া যায়। ৩. বাইন্ডারদের যদি ম্যানেজ করা যায়। কারণ, বাইন্ডাররা এখন নোট ও গাইড বই এবং অমর একুশে বইমেলার বইয়ের কাজে ব্যস্ত। সেখানে তারা উচ্চ মজুরি পাচ্ছেন। কিন্তু পাঠ্য পুস্তকের জন্য টেন্ডারে নির্ধারিত মজুরি অনেক কম।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে, সব ক্লাস মিলিয়ে মোট ৪০ কোটি বইয়ের মধ্যে জানুয়ারির শেষ দিন পর্যন্ত প্রায় ২১ কোটি বইয়ের কাজ শেষ হয়েছে, অর্থাৎ এখনো ১৯ কোটি বইয়ের কাজ বাকি।
তবে এখানেও হিসাবের ফাঁকি আছে বলে জানান প্রকাশকরা। তারা বলছেন, বইয়ের সংখ্যা হিসাব করলে প্রকৃত অগ্রগতি বোঝা যাবে না, কারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যার চেয়ে নবম ও দশম শ্রেণির পৃষ্ঠা সংখ্যা অনেক বেশি।সেই হিসাবে এখন পর্যন্ত শতকরা ৪২ শতাংশ বই ছাঁপা হয়েছে বলে তাদের দাবি৷
সবচেয়ে পিছিয়ে আছে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির বইয়ের কাজ। পৃষ্ঠা সংখ্যা বেশি হওয়ায় ওসব বইয়ের মাত্র ৩৪ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে। এই চার শ্রেণির ৬৬ শতাংশ বইয়ের কাজই বাকি।
তা সত্ত্বেও ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে শিক্ষার্থীরা সব পাঠ্যবই হাতে পাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
সম্প্রতি তিনি বলেন, ‘‘প্রথম দিকে আমরা আর্ট পেপার পাচ্ছিলাম না। কাগজের সংকটও ছিল। পরে ছাত্র প্রতিনিধি, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও অন্যদের সহায়তায় সে সমস্যার সমাধান হয়েছে।”
এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, “২৩-২৪ কোটি বই ছাপা হয়েছে আর ১৬-১৭ কোটি বাকি আছে। আমরা আশা করছি, ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখের মধ্যে আরো ১০-১২ কোটি বই দিতে পারবো আর ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাকি বইগুলো আমরা স্কুল পর্যায়ে পাঠিয়ে দিতে পারবো।”
সঠিক সময়ে বই ছাপা না হওয়ার কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, “প্রকাশকরা তাদের যে সক্ষমতার কথা বলেছেন, বাস্তবে তাদের সেই সক্ষমতা তিন ভাগের এক ভাগ। ব্যাংকের লোন নিয়ে সমস্যা ছিল, সেগুলো আমরা সমাধন করে দিচ্ছি। তারা এখন ৩৬ কোটি টাকা লোন পাবে। আর বইয়ের কাভারের জন্য আর্ট কার্ডের সমস্যা ছিল, বিদেশ থেকে আমদানি করে সেটা সমাধান করা হয়েছে। কাগজের দাম বেড়ে যাচ্ছিল, তা-ও একটা নেগোসিয়েশন করে দেয়া হচ্ছে। এখন বাইন্ডিংয়ের একটা সমস্যা আছে। তাদের অটো বাইন্ডিং মেশিন নাই। বাইন্ডাররা এখন নোট, গাইড ও বই মেলার বই নিয়ে ব্যস্ত। ফলে বই ছাপা হয়ে আছে, কিন্তু বাইন্ডিং করা যাচ্ছে না। আমরা তাদের বাইন্ডারের ব্যবস্থা করে দেয়ারও চেষ্টা করছি।”
“আশা করছি, এই মাসের মধ্যে সব বই চলে যাবে। তারপর বিলি করতে যা সময়। অনলাইনে সব বই পাওয়া যাচ্ছে। সেখান থেকে সবাই পড়তে পারছে,” বলেন তিনি।
প্রতি বছর জুলাই-আগস্টে মাসে বই ছাপা শুরু হলেও এবার শুরু হয়েছে ডিসেম্বরে। বইয়ে পরিবর্তনও এসেছে। ফ্রন্ট এবং ব্যাক কাভারেও পরিবর্তন করা হয়েছে। আগে নতুন বছরের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীরা হাতে নতুন বই পেলেও এবার প্রথম দিনে ৪০ কোটি বইয়ের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ছয় কোটি আট লাখ ১৯ হাজার ৪৪টি বই বিতরণ করা হয়েছে, যা শতকরা হিসেবে মোট বইয়ের ১৫-১৬ শতাংশ।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা চার কোটি ৩৪ লাখ তিন হাজার ২৮৩ জন। তাদের জন্য ছাপতে হবে ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ কপি বই। প্রাথমিকের দুই কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৯ শিক্ষার্থীর জন ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৫টি বই, মাধ্যমিক পর্যায়ের দুই কোটি ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮০৪ শিক্ষার্থীর জন্য ৩০ কোটি ৯৬ লাখ ১২ হাজার ৮৪৭ কপি বই ছাপা হয়। এ ছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য সাড়ে আট হাজারের বেশি ব্রেইল বই ছাপা হচ্ছে। শিক্ষকদের জন্য প্রায় ৪১ লাখ সহায়িকা ছাপা হচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি সামসুদ্দিন আহমেদ মাসুদ বলেন, “শহরের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে অনেকেই বই পেয়েছে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে বই যায়নি। মাধ্যমিকের চেয়ে প্রাথমিকে বই বেশি পেয়েছে। শিক্ষার্থীরা যারা বই পায়নি, তারা অন্যের বইয়ের সহায়তা নিচ্ছে।”
পিরোজপুরের মিরুখালি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলমগীর হোসেন জানান, “আসলে মাধ্যমিক পর্যায়ের বইয়ের সংকট বেশি। তবে আামাদের বলা হয়েছে, চলতি মাসের মধ্যেই বই পাঠানো হবে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “অনলাইন থেকে বই পড়ার সুবিধা অনেকেরই নাই। আর ডাউনলোড করে প্রিন্ট নিয়ে পড়তে গেলে তার অখরচ অনেক বেশি।”
বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রক ও বিপণন সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, “ক্লাস ফোরের একটি বই আছে ছয় ফর্মা (ফর্মায় ১৬ পৃষ্ঠা)। কিন্তু নবম-দশম শ্রেণির পদার্থ বিদ্যার এক কপি বইয়ে সাড়ে ৪৫ ফর্মা। ফলে বই হিসাব করে কাজের অগ্রগতি বোঝা যাবে না। পৃষ্ঠা হিসাব করে বুঝতে হবে। কারণ, পৃষ্ঠা কম হওয়ায় প্রাথমিকের বই আগে ছাপা হচ্ছে। এনসিটিবির হিসাবে এখন পর্যন্ত ৪৮ শতাংশ বই ছাপা হয়েছে। আর আমাদের হিসাবে এখন পর্যন্ত ৪২ শতাংশ ছাপা হয়েছে। তবে আশার কথা দশম শ্রেণির বই ছাপা প্রায় হয়ে গেছে। কিন্তু মাধ্যমিকের আনেক বই বাকি রয়ে গেছে।”
তার কথা, “আগে কাজ শুরু করতাম জুলাই-আগস্টে। কিন্তু এবার শুরু হয়েছে ডিসেম্বরে। তারপর বই পরিবর্তন হয়েছে। কাভার, ব্যাক কাভার পরিবর্তন হয়েছে। ফলে আমাদেরও অনেক কিছু পরিবর্তন করতে হয়েছে। আর ওয়ার্ক অর্ডারের পর লোন পেতে ঝামেলা। কাগজের ঝামেলা ছিল। আমরা আশা করছি, মার্চ নাগাদ সব বই দিতে পারবো। তবে যদি সব কিছু অনুকূলে থাকে।”
প্রকাশকদের সক্ষমতার প্রশ্নে তিনি বলেন, “আসলে তারা তো সক্ষমতা হিসাব করেই আমাদের কাজ দিয়েছেন। তাহলে এখন কেন সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন? আসলে ঠিক সময়ে কাজ শুরু না করায় এই পরিস্থিতি হয়েছে। আগে জুলাই মাস থেকে ধাপে ধাপে ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হতো। কোনো সংকট হতো না। আর এখন এই ফেব্রুয়ারি মাসে বাইন্ডার পাওয়া যায় না। এখন তারা নোট বই ও বই মেলার বইয়ের কাজে থাকে। ফলে আমরা এখন আরো একটি সমস্যায় পড়েছি।”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button