চট্টগ্রামে বিএনপি নেতাকর্মীদের রোষের মুখে ‘ওসি’ নেজাম
চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন বিএনপি নেতাকর্মীদের রোষের মুখে পড়েছেন। তাঁকে কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে পরনের শার্ট ছিঁড়ে ফেলা হয়। এ সময় ওসি থাকাকালীন নির্যাতনের নানা অভিযোগ তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন তারা।সোমবার দুপুর আড়াইটার দিকে পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসের সামনে এ ঘটনা ঘটে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিএনপি নেতাকর্মীরা পাঁচলাইশ থানার সামনে বিক্ষোভ করছেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পাঁচলাইশ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাজ্জাদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘স্যারকে আমরা হেফাজতে নিয়েছি। ঘটনা মাত্র ঘটলো। পরে বিস্তারিত জানানো যাবে।’
নেজাম উদ্দিন কোতোয়ালী, বাকলিয়া, সদরঘাট ও সবশেষ পটিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
‘ওসি’ নেজাম হাসপাতালে, অভিযোগ এলে অ্যাকশন!
সিভয়েস২৪ প্রতিবেদক
॥ ‘ওসি’ নেজাম হাসপাতালে, অভিযোগ এলে অ্যাকশন! ॥
‘ওসি’ নেজামকে পাসপোর্ট অফিস এলাকায় প্রথম দেখতে পান স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা শহীদ (বামে)। মারধরের শিকার পুলিশ কর্মকর্তা নেজাম উদ্দীন (ডানে)।
গণঅধিকার পরিষদের এক নেতার অণ্ডকোষ চেপে ধরেছিলেন নেজাম!
চট্টগ্রামে বিএনপি নেতাকর্মীদের রোষের মুখে পড়া আলোচিত সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন এখন দামপাড়া পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। পুলিশ বলছে, তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। ওসি নেজাম যে মামলায় আসামি সেটি তদন্তাধীন। আর তা সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ারাধীন।
অন্যদিকে, ব্যস্ত সড়কে প্রকাশ্যে তাকে মারধরের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন কিনা— এটিও ওসি নেজামের বিষয়। তিনি অভিযোগ দিলে পুলিশ বিষয়টি ‘দেখবে’।
সোমবার (৬ জানুয়ারি) নগরের পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসের সামনে বিএনপি নেতাকর্মীদের রোষের মুখে পড়েন পুলিশ কর্মকর্তা নেজাম। এ সময় তাকে মারধর করে পরনের জামা কাপড় ছিঁড়ে দেওয়া হয়। পরে খবর পেয়ে নেজাম উদ্দীনকে হেফাজতে নেয় পাঁচলাইশ থানা পুলিশ।
এদিকে, ঘটনাস্থল থেকে তাকে পুলিশ হেফাজতে নিলেও থানার বাইরে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। তাদের অভিযোগ—ওসি নেজাম নগরের বিভিন্ন থানার দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে আওয়ামী লীগের হয়ে নানা নির্যাতন-অত্যাচার চালিয়েছেন। অনেককে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়েছেন। এ সময় তারা থানা থেকে সাবেক ওসি নেজাম উদ্দীনকে ছেড়ে দেওয়ারও অভিযোগ তোলেন। পরে অবশ্য পুলিশের আশ্বাস পেয়ে থানা প্রাঙ্গণ ছাড়েন বিক্ষুব্ধরা।
থানা প্রাঙ্গণে চকবাজার থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব শহিদুল ইসলাম শহীদ বলেন, ‘ওসি নেজাম বাকলিয়া থাকাকালীন আমাদেরকে যেখানে পেয়েছে সেখানে মেরেছেন। তিনি আমাকে লাঠি দিয়ে গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে মেরেছিলেন। প্রকাশ করলে ঘরের সবাইকে তুলে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।’
‘কিন্তু সোমবার ঘটনার পর পাঁচলাইশ থানা পুলিশ আমাদের সাথে কথা না বলেই তাকে ছেড়ে দিয়েছে। এটার সুষ্ঠু বিচার না হলে ওসি সোলায়মানের প্রত্যাহার চাই।’-বলেন শহীদ।
গণঅধিকার পরিষদের এক নেতা বলেন, ‘২০২১ সালে মোদীবিরোধী আন্দোলন এবং কুমিল্লায় মন্দির ভাঙার মামলায় আমাকে গ্রেপ্তার করেছিলেন কোতোয়ালী থানার সাবেক ওসি নেজাম। অথচ ঘটনাটি ঘটেছিল কুমিল্লায়। থানায় এনে আমাকে সারারাত নির্যাতন করা হয়েছিল। তিনি আমার অণ্ডকোষ চেপে ধরলে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। হুঁশ ফিরলে তিনি আমাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে আমার আরও ১০ সহযোদ্ধাকে গ্রেপ্তার করে। এরপর থানায় নিয়ে আমার দুই হাত বেঁধে এমনভাবে পিটিয়েছেন আমার দুই হাত ফুলে গিয়েছিল। আমি একটা নাপা খেতে চেয়েছিলাম ব্যাথায়, দেননি তিনি।’
নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘পরদিন ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ডে নিয়েও অসহ্য নির্যাতন করেছে আমাদের। একজন মারে জ্ঞান হারাই, হুঁশ ফিরলে আবার আরেকজন মারে। তিনমাস জেল খেটে বেরোনোর পর খুন করার হুমকিও দিয়েছিলেন এই ওসি নেজাম। আমরা চাই ওসি নেজামকে ফাঁসি দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে দেখানো হোক। ফ্যাসিস্টের আমলে যে বা যারাই অপরাধ করেছে তারা ওসি নেজামের মতো শাস্তি পাবে।’
‘ওসি’ নেজাম যেভাবে বিএনপি নেতাকর্মীদের নজরে
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, সোমবার দুপুরে নগরের পাঁচলাইশ থানার পাসপোর্ট অফিস সংলগ্ন এলাকা হয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা নেজাম উদ্দীন। এ সময় তাকে দেখতে পান চকবাজার থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব শহিদুল ইসলাম শহীদ এবং দক্ষিণ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ সাংগঠনিক সম্পাদক নুর হোসেন। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন নেতাকর্মী ছিলেন। একপর্যায়ে নেজামের কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে পরনের শার্ট ছিঁড়ে ফেলে বিক্ষুব্ধরা। তাকে মারধরও করা হয়।
পরে খবর পেয়ে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ হেফাজতে নেয় নেজাম উদ্দীনকে। এরই মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা শহিদুল ইসলাম শহীদ ফেসবুক তার ফেসবুক আইডিতে একটি লাইভ করেন। পরবর্তীতে ‘সবাই পাঁচলাইশ থানার সামনে আসেন, ওসি নেজামকে ধরছি’ লিখে একটি স্ট্যাটাস দেন। এই খবরে পাঁচলাইশ থানার সামনে জড়ো হন শতাধিক বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। নেজামকে গ্রেপ্তার দেখানোর দাবিতে তারা বিক্ষোভ করতে থাকেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করে পুলিশ।
স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা শহিদুল বলেন, ‘আমি পাসপোর্ট অফিসে একটা কাজে গিয়েছিলাম। সেখানে আমরা তাকে দেখতে পাই। তাকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি কোত্থেকে এসেছেন। তিনি বলেন, তিনি ঢাকা থেকে ছুটি নিয়ে এসেছেন। তিনি ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। আমরা বলেছি, আপনি আমাদের এত বছর অত্যাচার করছেন আমরাও তো অনুরোধ করে পা পর্যন্ত ধরেছিলাম। আপনি আমাদের ছাড়েননি। তিনি আমাদের বলেন, উপরের নির্দেশ ছিল।
‘এরপর আমি তাকে টেনে নিয়ে আসতেছিলাম। ওসি সোলায়মান ভাই বলেছেন, ছেড়ে দিতে পুলিশের কাছে। কিন্তু আমরা থানায় আসার পর দেখছি তারা ওসি নেজামকে ছেড়ে দিয়েছেন।’-অভিযোগ শহীদের।
নেজামকে মারধরের কথা শুনে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেন বিএনপি নেতা
আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা নেজাম উদ্দীনকে দলীয় নেতাকর্মীদের মারধরের ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চট্টগ্রাম নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ এবং সদস্য সচিব নাজিমুর রহমানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা সাড়া দেননি।
পরে এ প্রসঙ্গে জানতে চট্টগ্রাম নগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক (দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত) শওকত আলম খাজার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। ‘কোতোয়ালী থানার সাবেক ওসি নেজাম উদ্দীনকে মারধরের’ বিষয়টি শুনেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।
পুলিশ যা বলছে
সবশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) মুহাম্মদ ফয়সাল আহম্মেদ বলেন, ‘বর্তমানে পরিস্থিতি পুরোপুরি শান্ত আছে। বিক্ষুব্ধরা থানা প্রাঙ্গণ ছেড়ে চলে গিয়েছেন। পুলিশ কর্মকর্তা নেজাম উদ্দীন দামপাড়া পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।’
ওই পুলিশ কর্মকর্তা মারধরের ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেবেন কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি আমরা এখনই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না। আমরা আলাপ করবো এ বিষয়ে। উনি এখন চিকিৎসাধীন আছেন। সুস্থ হলে অভিযোগ দিলে তারপর দেখা যাবে।’
বিক্ষুব্ধদের গ্রেপ্তার দেখানোর দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা কিভাবে দেখাবো? একটা নালিশি মামলায় (সিআর) কি গ্রেপ্তার দেখানো যায়? নেজাম যে মামলার আসামি মামলাটি আদালতে হয়েছে এবং তদন্তাধীন বিষয়।’
জানা গেছে, পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন বর্তমানে ঢাকায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) কর্মরত রয়েছেন। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সবশেষ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পটিয়া-১২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সামশুল হক চৌধুরীর সঙ্গে গোপন বৈঠকের অভিযোগে ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর তাকে জেলার বাইরে বদলির আদেশ দেয় নির্বাচন কমিশন। এছাড়া তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালী, বাকলিয়া ও সদরঘাট থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।