নথি চাওয়ার পরই সচিবালয়ে আগুন কি ষড়যন্ত্রমূলক?
বাংলাদেশ সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগার ঘটনাটি ষড়যন্ত্রমূলক কি না? এটা এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। আগুন লাগানোতে নাশকতা রয়েছে না কি, এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সরাসরি বলেছেন তদন্তের পর বলা যাবে। তবে বসে নেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা ও রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ বিভিন্ন দল। ইতোমধ্যেই তারা আগুন লাগার ঘটনাটির সঙ্গে ষড়যন্ত্রের আঁচ খুঁজে পেয়েছেন। নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘হুশিয়ারি বার্তা’ দিয়েছেন তারা।
সচিবালয়ে ১ নম্বর গেট দিয়ে প্রবেশ করলে সামনেই পড়বে ৭ নম্বর ভবন। সচিবালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সাত নম্বর ভবনে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় ও এই মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ; অর্থ মন্ত্রণালয় ও এর অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ; শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়; স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ও এর স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও এর ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দপ্তর রয়েছে।
বুধবার দিবাগত রাত ১টা ৫২ মিনিটে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে লাগা আগুন বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা ৫ মিনিটে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। সংস্থাটি বলছে, খবর পেয়ে ১টা ৫৪ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে আগুন সম্পূর্ণ নির্বাপণ করা হয়।
শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের নথি চাওয়ার পর সচিবালয়ে ভয়াবহ আগুন লাগা ও অনেক নথি পুড়ে যাওয়া দেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে বলে মন্তব্য করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, এই আগুনের ঘটনায় মানুষের মনে বিরাট প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। চারদিকের বিভিন্ন ঘটনায় আমরা ভয়ার্ত। ব্যক্তিগতভাবে নয়, রাষ্ট্রীয়ভাবে ভয়ার্ত। আমরা এর আগেও দেখেছি যখন কোনো মন্ত্রী-সচিবের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ আসে, তখন সচিবালয়ের ফাইল গায়েব হয়ে যায়। আগুন লেগে যায়।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ এই নেতা বলেন, গতকালই সংবাদপত্রে দেখেছি, অন্তর্বর্তী সরকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নথি চেয়ে পাঠিয়েছে। নথি চাওয়ার পর আগুন নিয়ে জনগণের মনে বিরাট প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সচিবালয়ের আগুনের ঘটনায় উচ্চ পর্যায়ের একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানাই।
সচিবালয়ে কীভাবে আগুন লাগলো— আজকেই জানতে চাই
সচিবালয়ে কীভাবে আগুন লাগলো তা আজকের মধ্যেই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে জানতে চেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদীন ফারুক। বৃহস্পতিবার প্রেসক্লাবে তিনি বলেন, অফিস বন্ধ, অফিসে নিরাপত্তা কর্মী দায়িত্বে থাকে তারপরও কিভাবে আগুন লাগল। এটা আমি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে আজকের মধ্যেই জানতে চাই।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সতর্ক করে বিএনপির সাবেক এই চিপ হুইপ বলেন: আমরা বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারকে আগেই সতর্ক করেছিলাম যেন শেখ হাসিনা সরকারের দোসরদের সচিবালয় থেকে অপসারণ করা হয়। শেখ হাসিনার দোসরা আবারো ষড়যন্ত্র করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনার চেষ্টা করছে। এটা আমরা কোনোভাবেই হাতে দেব না।
আগুন নিয়ে যা বলছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা
সচিবালয়ের লাগা আগুনে পুড়ে গেছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার দুটি মন্ত্রণালয়। বিষণ্ন মনে পুড়ে যাওয়া ভবন দেখে গেছেন তিনি।
এর আগে সকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের আইডিতে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে আসিফ মাহমুদ বলেন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বিগত সময়ে হওয়া অর্থলোপাট, দুর্নীতি নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম। কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছিল। আগুনে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এখনো জানা যায়নি। আমাদেরকে ব্যর্থ করার এই ষড়যন্ত্রে যে বা যারাই জড়িত থাকবে তাদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়া হবে না।
ফ্যাসিজমের এনাবলারদের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের উদারতা দেখানোর পরিণাম এই কপালপোড়া জাতিকে অনন্তকাল ভোগাবে বলে মন্তব্য করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। ফেসবুকের এক পোস্টে তিনি বলেন, হাসিনার ঘি খাওয়া ফ্যাসিস্ট এনাবেলররাই এখন মানবাধিকারের আলাপ দিয়ে ফ্যাসিস্টদের পক্ষে ‘সিমপ্যাথি গেইন’ ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে। এই ক্যাম্পেইন না থামাতে পারলে আপনি শেষ। আজকে আমলা আগামীকাল অন্য কেউ।
সচিবালয়ের মূল ফটকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সচিবালয়ে ঘাপটি মেরে থাকা হাসিনার দালালেরা বিভিন্ন অপকর্মের ফাইলগুলো আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম। আমলাতন্ত্র ও প্রশাসনে যেসব চাটার দল এখনো ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে তাদের শেকড় থেকে উপড়ে ফেলতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ফেসবুকে আইডি থেকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি আরও বলেন, বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের যারা চাটার দল ছিলো তাদের মধ্যে অন্যতম একটা অংশ এই আমলারা। এদের ওপর ভর দিয়েই হাসিনা এই দেশে তার ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিলো। যখনই বিপ্লবীরা হাসিনার অপকর্ম, চুরি, লুটপাট, দুর্নীতির দিকে নজর দিয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে তখনই সচিবালয়ে ঘাপটি মেরে থাকা হাসিনার দালালেরা বিভিন্ন অপকর্মের ফাইলগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে দিলো। রাষ্ট্র সংস্কার করতে হলে প্রশাসনে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা চাটার দলকে শেকড় থেকে উপড়ে ফেলতে হবে। সাবধান করার সময় আর নেই।
আগুন কী ষড়যন্ত্র, যা বলছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
সচিবালয়ের আগুনের ঘটনাটি ষড়যন্ত্রের অংশ কী না তা জানতে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। বলেছেন তদন্তের পর জানা যাবে এটা নাশকতা কী না।
সচিবালয়ের মতো সুরক্ষিত জায়গায় এত বড় আগুন লাগা নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের বিষয়ে তিনি বলেন, দুর্ঘটনা তো সব জায়গায় হতে পারে। সচিবালয়েও হতে পারে। এ জন্যই তো এখানেও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি রাখা হয়। আগুনের উৎস এবং এটা নাশকতা কি না এমন প্রশ্নে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, তদন্তের পর বলা যাবে।
এদিকে সচিবালয়ে আগুন লাগার কারণ খুঁজতে ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়, অগ্নিকাণ্ডের উৎস ও কারণ উদঘাটন, অগ্নি দুর্ঘটনার পেছনে কারো ব্যক্তিগত বা পেশাগত দায়দায়িত্ব আছে কি না তা উদঘাটন, এ জাতীয় দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে সুপারিশ প্রেরণ।
কমিটি প্রয়োজনে এক বা একাধিক সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে। কমিটি আগামী ৭ (সাত) কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়েছে।
আগুনের উৎস এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি: ফায়ার সার্ভিস
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেছেন আগুনের উৎস এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে। তারপরও আমরা নিশ্চিত না হয়ে এ বিষয়ে কিছুই বলতে চাই না।
মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, রাতভর জ্বলা আগুনে ভবনটির ছয়, সাত, আট ও ৯ তলা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া বেশিরভাগ তলায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। মূলত বিদ্যুৎ লাইন দিয়ে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল।
আগুন নিয়ন্ত্রণে তাদের ২০ ইউনিট ও ২১১ ফায়ারকর্মী কাজ করেছে। তবে জায়গা সংকটের কারণে ১০টি ইউনিট-ই সক্রিয়ভাবে কাজ করতে পেরেছে।