ধ্রুবকন্ঠ | Dhruba Kantho

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রিমিয়াম কনটেন্ট কি চলবে?



বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রিমিয়াম কনটেন্ট কি চলবে?

বাংলাদেশের মিডিয়া মার্কেটে অনলাইন গণমাধ্যমের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে, সাথে বাড়ছে পত্রিকা, টেলিভিশনও। মাঝে রেডিও বাড়লেও তা এখন কমতে কমতে শূন্যের পর্যায়ে চলে এসেছে। মোটাদাগে বলা যায়, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও প্রায় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান আসলে ভর্তুকি দিয়ে চলে।

সাংবাদিক কমিউনিটির বাইরের মানুষের কাছে এই তথ্য অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্য যে, পিওর অনলাইন অর্থাৎ যাদের টেলিভিশন চ্যানেল কিংবা প্রিন্ট পত্রিকা নেই, সেসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ ভর্তুকিতে চলে। সেই জায়গায় প্রিমিয়াম কনটেন্ট (অর্থের বিনিময়ে কনটেন্ট) আকাশকুসুম কল্পনাও বটে। দেশের মিডিয়া মার্কেটের কেন এই অবস্থা, কীভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হবে, সেই উত্তর খুঁজব এই লেখায়।

বিশ্বজুড়ে অনলাইন সাংবাদিকতার অর্থনৈতিক সংকটকে ‘নিউজ ডেজার্ট’ হিসেবে ব্যাখ্যা করছে আন্তর্জাতিক গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো। অর্থাৎ, বিজ্ঞাপন ও পাঠক উভয়ের নির্ভরতা এখন মূলত বড় টেক প্ল্যাটফর্মগুলোর (Meta, Google, YouTube) ওপর। বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরও বেশি খারাপ।

জার্মান-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ডেটা ও পরিসংখ্যান বিষয়ক গবেষণা প্ল্যাটফর্ম স্ট্যাটিসটিয়া (Statista)-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী,  ২০২৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে এ খাতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার হবে ‘ঋণাত্মক ০.১৭ শতাংশ’, অর্থাৎ বাজার আরও সংকুচিত হবে।

উন্নত দেশগুলোর গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও প্রায়ই আর্থিক সংকটের কথা শোনা যায়। তবে নিউইয়র্ক টাইমসের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যারা প্রিমিয়াম কনটেন্টের শক্তিতে লাভবান হচ্ছে। তাদের পাশাপাশি ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, দ্য ইকনমিস্ট, দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, দ্য গার্ডিয়ান,  দ্য অ্যাথলেটিক, সাবস্ট্যাক নেটিভ আউটলেটস, স্কাই নিউজ (ইউকে), এএফপি এবং রয়টার্সের মতো গণমাধ্যমও প্রিমিয়াম কনটেন্টের শক্তিতে ভালোভাবেই টিকে আছে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হাতেগোনা কয়েকটি গণমাধ্যম তাদের ই-পেপার পেইড করলেও প্রিমিয়াম কনটেন্ট মডেল কোনো গণমাধ্যম চালু করতে পারেনি।

নিউইয়র্ক টাইমস যেভাবে লাভে

যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসকে পৃথিবীর অন্যতম প্রভাবশালী গণমাধ্যম বিবেচনা করা হয়। ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট তারা ‘ত্রৈমাসিক সাবস্ক্রিপশন’ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে জানায়, কোয়ার্টার ২ তে তাদের ডিজিটাল অনলি (শুধুমাত্র ডিজিটাল সাবস্ক্রাইবার) যুক্ত হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার। গণমাধ্যমটি তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, এই সংখ্যা তাদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি।

বর্তমানে নিউইয়র্ক টাইমসের মোট ‘ডিজিটাল-অনলি’ সাবস্ক্রাইবার ১ কোটি ১৩ লাখ (১১.৩০ মিলিয়ন)। এর মধ্যে প্রায় ৬.০২ মিলিয়ন ব্যবহারকারী একাধিক প্রোডাক্ট বা বান্ডল সাবস্ক্রিপশন ব্যবহার করেন। প্রিন্ট সংস্করণসহ মোট সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১৮ লাখ ৮০ হাজার (১১.৮৮ মিলিয়ন)। এটি ২০২৫ সালের আগস্ট মাসের তথ্য। কোম্পানির লক্ষ্য ২০২৭ সালের মধ্যে ১ কোটি ৫০ লাখ সাবস্ক্রাইবারে পৌঁছানো।

মুনাফা: এই ত্রৈমাসিকে নিউইয়র্ক টাইমসের মোট রাজস্ব বেড়েছে ৯.৭ শতাংশ, যা দাঁড়িয়েছে ৬৮৫.৯ মিলিয়ন ডলারে। প্রতি শেয়ারে সমন্বিত মুনাফা ৫৮ সেন্ট, যা অনুমিত ৫০ সেন্টের চেয়ে বেশি।

ডিজিটাল বিজ্ঞাপন আয় বেড়েছে ১৮.৭ শতাংশ, মোট ৯৪.৪ মিলিয়ন ডলার। ডিজিটাল-অনলি গ্রাহক প্রতি গড় আয় বেড়ে হয়েছে ৯.৬৪ ডলার, যা ৩.২ শতাংশ বৃদ্ধি নির্দেশ করে।

কীভাবে এই সাফল্য: সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে নিউইয়র্ক টাইমস এই সাফল্য পাচ্ছে। এমনিতে তাদের সংবাদ, অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু আয় বাড়াতে কনটেন্ট স্ট্র্যাটেজি অন্যদের চেয়ে কিছুটা আলাদা। মূল নিউজ কনটেন্টের পাশাপাশি তারা স্পোর্টস প্ল্যাটফর্ম The Athletic, গেম Wordle এবং প্রোডাক্ট রিভিউ সাইট Wirecutter-এর মাধ্যমে নতুন পাঠক টানছে। প্রিমিয়াম খাত থেকে আয় বাড়াতে মূলত তারা লাইফস্টাইল কনটেন্টে বেশি জোর দিয়েছে। তাদের লক্ষ্য হলো এমন ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করা, যারা শুধুমাত্র খবর নয়, লাইফস্টাইলকেন্দ্রিক কনটেন্টেও আগ্রহী।

এই মডেলকে ‘লাইফস্টাইল+জার্নালিজম’ কৌশল বলা যেতে পারে। গণমাধ্যমটি বুঝেছে, আজকের তরুণ ও মধ্যবয়সী পাঠকরা নিউজ পড়তে নয়, ‘এক্সপেরিয়েন্স নিতে’ আসে। তাই তারা নিউজের সঙ্গে লাইফস্টাইল কনটেন্ট যুক্ত করেছে। যেখানে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক খবরের পাশাপাশি রয়েছে ব্যক্তিগত জীবন, স্বাস্থ্য, ফুড, গেমস এবং শিক্ষা বিষয়ক কনটেন্ট।

‘ইনফরমেশন’-এর সঙ্গে ‘ইন্টারঅ্যাকশন’ মিশিয়ে পাঠকের সময় ধরে রাখছে। এটি একধরনের ‘ইমারসিভ জার্নালিজম’ বা ‘লাইফস্টাইল-নিউজ হাইব্রিড মডেল’, যা প্রচলিত নিউজরুমের ধারণাকে ভেঙে নতুন আয়ের পথ তৈরি করেছে।

বাংলাদেশে ‘সংবাদ মানে ফ্রি’ এই প্রবণতা প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ‘প্রিমিয়াম কনটেন্ট’ এখানে দুঃস্বপ্নের মতোই বলা চলে। অথচ বাংলাদেশের ওটিটি প্ল্যাটফর্মের পেইড ভার্সনে নাটক-সিনেমা দেখার প্রবণতা দিনকে দিন বাড়ছে। মার্কেট খুঁজে পাচ্ছে না শুধু গণমাধ্যম।

অন্যদিকে দ্য গার্ডিয়ানের ক্ষেত্রে আমরা দেখি ‘ভালো সাংবাদিকতা’ টিকিয়ে রাখতে বিশ্ববিখ্যাত এই প্রতিষ্ঠানগুলো কখনো প্রিমিয়াম কনটেন্ট বিক্রি করে (সাবস্ক্রিবশন মডেল), কখনো আবার সরাসরি ডোনেশন বা মেম্বারশিপ মডেল চালু করে। এসব প্রক্রিয়ায় তারাও ভালোভাবেই টিকে যাচ্ছে। মানুষ ডলার বা পাউন্ড খরচ করে তাদের ওয়েবসাইট সাবস্ক্রাইব করে টেক্সট নিউজ পড়ছে। এএফপি, রয়টার্সের মতো এজেন্সি টেক্সটের পাশাপাশি ভিডিও ফুটেজ বিক্রি করছে। এটি ‘সিন্ডিকেশন ইকনোমি’ নামে পরিচিত।

বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে

বাংলাদেশে ‘সংবাদ মানে ফ্রি’ এই প্রবণতা প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ‘প্রিমিয়াম কনটেন্ট’ এখানে দুঃস্বপ্নের মতোই বলা চলে। অথচ বাংলাদেশের ওটিটি প্ল্যাটফর্মের পেইড ভার্সনে নাটক-সিনেমা দেখার প্রবণতা দিনকে দিন বাড়ছে। মার্কেট খুঁজে পাচ্ছে না শুধু গণমাধ্যম।

বাংলাদেশি মিডিয়া মার্কেটের প্রধানতম আয়ের উৎস স্থানীয় কোম্পানির বিজ্ঞাপন। কিন্তু সরকার পরিবর্তন হলে গণমাধ্যমভেদে বিজ্ঞাপন পাওয়ার হার কমে যায়। মিডিয়ার ওপর ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’ এতটাই প্রভাব ফেলে যে প্রতিষ্ঠান টেকানো দায় হয়ে পড়ে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের।

ডিজিটাল বনাম প্রিন্ট

যেসব প্রিন্ট পত্রিকা এবং টেলিভিশনের ডিজিটাল মাধ্যমে জনপ্রিয়, তারা খুব একটা লাভ না করলেও তাদের লোকসান বা ভর্তুকির হার তুলনামূলক কম। কিন্তু যাদের প্রিন্ট নেই, স্যাটেলাইটও নেই শুধু নিউজ পোর্টাল, তারা অনেকেই লোকসানে।

নিউজ পোর্টালগুলো যতই জনপ্রিয় হোক না কেন, স্থানীয় কোম্পানি বিজ্ঞাপনের রেট বাড়াতে চায় না। অনেক ক্ষেত্রে প্রিন্ট না থাকলে বিজ্ঞাপনই দিতে চায় না। স্থানীয় কোম্পানির এই দ্বিচারিতা ঠেকাতে সরকার আলাদা নীতিমালা না করলে ডিজিটাল মিডিয়ার ভবিষ্যৎ সামনে আরও খারাপ হবে। গুণগত মান কমে যাবে। এতে রাষ্ট্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ আরও হেলে পড়বে।

এই পরিস্থিতি আসলে ‘ট্রাস্ট ইকোনমির’ সংকট, যা গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় বিরাজমান। বিজ্ঞাপনদাতারা এখনো ‘প্রিন্ট ও টিভিকে বেশি বিশ্বাসযোগ্য’ মনে করেন। ফলে ডিজিটাল মিডিয়া অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে যায়।

স্ট্যাটিসটিয়ার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এই খাতের সবচেয়ে বড় অংশ এখনো প্রিন্ট সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন, যার বাজারমূল্য (২০২৫ সাল নাগাদ) প্রায় ২২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

নিউজ পোর্টালগুলোর লোকসানের আরেকটি বড় কারণ ‘টেক্সট নিউজ’ সেল করতে না পারা। নিউজকে যদি পণ্য ধরি, তাহলে তার গুণাগুণ (নিরপেক্ষতা ও গভীরতা) ঠিক রেখে বিক্রি করার মতো গুণমান অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের নেই। এজন্য প্রিমিয়াম কনটেন্ট পদ্ধতি এখনো অলীক ভাবনা।

এখানে যুক্তির খাতিরে নিউজকে পণ্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আমি জানি, সাংবাদিকতা কখনোই পণ্য হতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশের মিডিয়া-বিনিয়োগকারীদের এটা বোঝানো কঠিন। তারা বিনিয়োগের কয়েক মাসের মধ্যেই রিটার্ন চেয়ে সম্পাদকদের ঘুম নষ্ট করে দেন। একটা বছরও সময় দিতে চান না।

লিডারশিপে অজ্ঞতা

ডিজিটাল মিডিয়া বিষয়ক কনসালটেন্সি করতে গিয়ে আমি দেখেছি আমাদের সিনিয়র সাংবাদিকেরা টেকনিক্যালি এতটাই দুর্বল যে তাদের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন। তারা হয়তো সনাতনী সাংবাদিকতায় দারুণ, কিন্তু ডিজিটাল মিডিয়া দাঁড় করাতে পারছেন না।

এই প্রবণতাকে আধুনিক যুগে ‘লিগ্যাসি মিডিয়া ইনারশা’ বলা হয়। অর্থাৎ পুরোনো পদ্ধতির সাংবাদিকরা নতুন প্রযুক্তি ও অ্যালগরিদম নির্ভর নিউজ ইকোনমি বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

ভালো সাংবাদিকতা করেও প্রবীণরা যখন ডিজিটালে প্রচার-প্রসার বাড়াতে পারছেন না, তখন প্রকাশক বা বিনিয়োগকারী এমন ব্যক্তিদের কাছে যাচ্ছেন, যারা নৈতিকভাবে ‘গুজব সাংবাদিকতা’ বা ‘ক্লিকবেইট’-এর অভিযোগে বিদ্ধ। তখন সামনে আসে ‘ভিউ ইকোনমি’।

অথচ সত্য হলো, টেকনিক্যালি সাউন্ড হলে সনাতনী সাংবাদিকতা দিয়েই প্রচার-প্রসার বাড়ানো সবচেয়ে সহজ। যাদের প্রেজেন্টেশন ভালো, টেক্সট নিউজ শক্ত, সেই প্রতিষ্ঠানের টিম লিডার প্রযুক্তিতে দক্ষ হলে তারাই সহজে ‘ভিউ ইকোনমি’তে টিকে থাকতে পারেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে এখনো এমন ব্যক্তিদের রাখা হয়, যারা নিজেদের অজান্তেই ডিজিটাল নিউজরুমের পরিবেশ নষ্ট করছেন। তারা শিখতেও চান না।

টেক্সট নিউজ বনাম ভিডিও নিউজ

কোনটিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত-এই দ্বিধা এখনো অনেক সম্পাদক ও প্রকাশকের কাটেনি। কেউ কেউ মনে করেন টেক্সট নিউজ ওয়েবসাইটের প্রাণ। কিন্তু আমরা বহু গবেষণায় দেখছি, টেক্সট পড়ার প্রবণতা দিন দিন তলানিতে নামছে।

তবুও বাস্তবতা হলো, টেক্সট দুর্বল রেখে ভিডিও কনটেন্টে নজর দিলে পোর্টালের সাংবাদিকতাগত ও বৌদ্ধিক মূল্য অনেক কমে যায়। আবার টেক্সটে বেশি বিনিয়োগ করলে আয় আসে না। এই দোটানার কারণে অনেক ডিজিটাল মিডিয়া দীর্ঘমেয়াদে অস্থির হয়ে পড়ে।

গুগল অ্যাডসেন্স ও ফেসবুক ইনস্ট্যান্ট আর্টিকেল থেকে একসময় ভালো আয় হতো। এখন সেটিও অনিশ্চিত। মেটা ও গুগল প্রায় প্রতিবছর কনটেন্ট নীতিমালা ও রাজস্ব কাঠামো পাল্টায়। তাই এসব মাধ্যমে ভর করেও টেকা যাচ্ছে না।

টেক্সট নিউজ সেল করার আরও কিছু উপায় আছে, যা বড় প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ছাড়া সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে কনটেন্ট হতে হয় শতভাগ ইউনিক।

নিউজ পোর্টালগুলো যতই জনপ্রিয় হোক না কেন, স্থানীয় কোম্পানি বিজ্ঞাপনের রেট বাড়াতে চায় না। অনেক ক্ষেত্রে প্রিন্ট না থাকলে বিজ্ঞাপনই দিতে চায় না। স্থানীয় কোম্পানির এই দ্বিচারিতা ঠেকাতে সরকার আলাদা নীতিমালা না করলে ডিজিটাল মিডিয়ার ভবিষ্যৎ সামনে আরও খারাপ হবে। গুণগত মান কমে যাবে।

এতটুকু পড়ে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, প্রতিষ্ঠানের টপ ম্যানেজমেন্ট এসবে ‘আপ-টু-ডেট’ না হলে টিকে থাকা কঠিন। টেক্সট নিউজকে প্রিমিয়াম করতে হলে কনটেন্ট হতে হবে নিশ-স্পেসিফিক। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় এমন জায়গায় পৌঁছাতে হবে, মানুষ কিনতে বাধ্য হবে।

এছাড়া বিজনেস, এডুকেশন, এনভায়রনমেন্ট, টেক ইত্যাদি নির্দিষ্ট পাঠকগোষ্ঠী টার্গেট করেও মাইক্রো-পেওয়াল মডেল চালু করা যায়। কিন্তু ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস’ মানে পৌঁছানোর মতো প্রশিক্ষিত লেখক/ক্রিয়েটর আমাদের বাজারে খুব কম।

নাগরিক সাংবাদিকতায় ধরাশায়ী মূলধারার গণমাধ্যম

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিনামূল্যে তথ্যের যে বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে, তাতেই এখন পাঠকের চাহিদা মিটে যায়। বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যম যখন বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় তলানিতে, তখন নাগরিক সাংবাদিকতা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।

এটি ‘ডিসইন্টারমিডিয়েশন অফ জার্নালিজম’ নামে পরিচিত। অর্থাৎ সাংবাদিকতার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানকে পাস কাটিয়ে ব্যক্তি নিজেই নিউজ উৎস হয়ে উঠছে।

এইরকম অসংখ্য উদাহরণ আমাদের আশেপাশে। তারা মূলধারার মিডিয়ার 'গেটকিপিং' ছাড়াই জনগণের কাছে তথ্য পৌঁছে দিচ্ছেন। একদম বিনামূল্যে।

আর কী করা যেতে পারে

নিউইয়র্ক টাইমসের পাশাপাশি ফ্রান্সের Le Monde এবং স্পেনের El País প্রিমিয়াম কনটেন্টে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সবচেয়ে সফল হয়েছে। তারা মিশ্র কৌশল অবলম্বন করেছে। কেউ কঠোর পেওয়াল, কেউ হাইব্রিড মডেল (যেখানে কিছু খবর নিবন্ধন করলে ফ্রি, বাকি অংশ সাবস্ক্রাইবারদের জন্য), আবার প্রিমিয়াম মডেল ব্যবহার করছে ট্যাবলয়েড ধাঁচের মিডিয়া (Bild, VG), যেখানে কম মূল্যের সাবস্ক্রিপশন + বিজ্ঞাপনের রাজস্ব মিলিয়ে লাভ হচ্ছে।

এই কৌশলগুলো তাদের একইসঙ্গে ‘বিনামূল্যের পাঠক’ ও ‘প্রিমিয়াম পাঠক’ দুই গ্রুপকেই ধরে রাখতে সাহায্য করছে।

সফল প্রতিষ্ঠানগুলো তিনটি জিনিসে মিল রেখেছে: শক্তিশালী কনটেন্ট আইডেন্টিটি, একাধিক প্রোডাক্ট বা বান্ডল অফার এবং লক্ষ্যভিত্তিক পাঠক এনগেজমেন্ট।

রয়টার্স ইন্সটিটিউটের ডিজিটাল রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, মাত্র ১৭ শতাংশ মানুষ অনলাইন নিউজের জন্য টাকা দিতে রাজি এবং ৫৭ শতাংশ একেবারেই দিতে চায় না।

তবু আশা আছে। কিছু কৌশল ইতিমধ্যে ব্যবহার হচ্ছে, যা ভবিষ্যতের দিক নির্দেশ করে: দীর্ঘ বা সস্তা ট্রায়াল পিরিয়ড (যাতে নতুন পাঠক অভ্যস্ত হয়), মাল্টি-ব্র্যান্ড বান্ডল অফার (একসঙ্গে একাধিক মিডিয়া কনটেন্ট), নন-নিউজ ফিচার, যেমন গেমস, রেসিপি, পাজল এবং বিভিন্ন দামের সাবস্ক্রিপশন টিয়ার (কম দামের ডিজিটাল এডিশনসহ)।

এইসব কৌশল নতুন পাঠক টানতে সহায়ক হলেও, এর ভেতরে আবার ঝুঁকি আছে। প্রায় ৪১ শতাংশ সাবস্ক্রাইবার আসলে ডিসকাউন্টেড, অর্থাৎ পূর্ণ দাম দিতে চায় না।

এসব পেরিয়ে পাঠককে টাকা দিতে রাজি করাতে হলে নিউজ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজেদের ‘মূল্য’ প্রমাণ করতে হবে। এমন সাংবাদিকতা তৈরি করতে হবে যা অনুসন্ধানী, বিশ্বাসযোগ্য  এবং জীবনের অংশ হিসেবে দরকারি।

নিউজরুমকে ভাবতে হবে এক ধরনের কনটেন্ট ইনোভেশন ল্যাব হিসেবে, যেখানে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির পাশাপাশি কাজ করবে কনটেন্ট স্ট্র্যাটেজিস্ট, প্রোডাক্ট ম্যানেজার, অ্যানালিটিকস টিম এবং ব্র্যান্ড পার্টনারশিপ বিশেষজ্ঞরা। ‘ভালো সাংবাদিকতা’ হবে আলোর মতোই এক প্রিমিয়াম পণ্য। নিউজ নিজেই হয়ে উঠবে এক ‘ভ্যালু প্রোডাক্ট’।

তথ্যসূত্র:

১। https://www.statista.com/outlook/amo/media/bangladesh

২। https://www.reuters.com/business/new-york-times-subscriptions-boosted-by-bundling-news-lifestyle-content-2025-08-06

৩। https://reutersinstitute.politics.ox.ac.uk/digital-news-report/2024?utm_source=chatgpt.com

অমৃত মলঙ্গী : ভয়েস অফ আমেরিকার সাবেক বাংলাদেশি কন্ট্রিবিউটর; এআই ও ডিজিটাল মিডিয়া ট্রেইনার, নেটকম লার্নিং

amritamalangi@gmail.com


আপনার মতামত লিখুন

ধ্রুবকন্ঠ | Dhruba Kantho

বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫


বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রিমিয়াম কনটেন্ট কি চলবে?

প্রকাশের তারিখ : ৩০ অক্টোবর ২০২৫

featured Image

বাংলাদেশের মিডিয়া মার্কেটে অনলাইন গণমাধ্যমের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে, সাথে বাড়ছে পত্রিকা, টেলিভিশনও। মাঝে রেডিও বাড়লেও তা এখন কমতে কমতে শূন্যের পর্যায়ে চলে এসেছে। মোটাদাগে বলা যায়, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও প্রায় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান আসলে ভর্তুকি দিয়ে চলে।

সাংবাদিক কমিউনিটির বাইরের মানুষের কাছে এই তথ্য অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্য যে, পিওর অনলাইন অর্থাৎ যাদের টেলিভিশন চ্যানেল কিংবা প্রিন্ট পত্রিকা নেই, সেসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ ভর্তুকিতে চলে। সেই জায়গায় প্রিমিয়াম কনটেন্ট (অর্থের বিনিময়ে কনটেন্ট) আকাশকুসুম কল্পনাও বটে। দেশের মিডিয়া মার্কেটের কেন এই অবস্থা, কীভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হবে, সেই উত্তর খুঁজব এই লেখায়।

বিশ্বজুড়ে অনলাইন সাংবাদিকতার অর্থনৈতিক সংকটকে ‘নিউজ ডেজার্ট’ হিসেবে ব্যাখ্যা করছে আন্তর্জাতিক গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো। অর্থাৎ, বিজ্ঞাপন ও পাঠক উভয়ের নির্ভরতা এখন মূলত বড় টেক প্ল্যাটফর্মগুলোর (Meta, Google, YouTube) ওপর। বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরও বেশি খারাপ।

জার্মান-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ডেটা ও পরিসংখ্যান বিষয়ক গবেষণা প্ল্যাটফর্ম স্ট্যাটিসটিয়া (Statista)-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী,  ২০২৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে এ খাতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার হবে ‘ঋণাত্মক ০.১৭ শতাংশ’, অর্থাৎ বাজার আরও সংকুচিত হবে।

উন্নত দেশগুলোর গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও প্রায়ই আর্থিক সংকটের কথা শোনা যায়। তবে নিউইয়র্ক টাইমসের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যারা প্রিমিয়াম কনটেন্টের শক্তিতে লাভবান হচ্ছে। তাদের পাশাপাশি ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, দ্য ইকনমিস্ট, দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, দ্য গার্ডিয়ান,  দ্য অ্যাথলেটিক, সাবস্ট্যাক নেটিভ আউটলেটস, স্কাই নিউজ (ইউকে), এএফপি এবং রয়টার্সের মতো গণমাধ্যমও প্রিমিয়াম কনটেন্টের শক্তিতে ভালোভাবেই টিকে আছে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হাতেগোনা কয়েকটি গণমাধ্যম তাদের ই-পেপার পেইড করলেও প্রিমিয়াম কনটেন্ট মডেল কোনো গণমাধ্যম চালু করতে পারেনি।

নিউইয়র্ক টাইমস যেভাবে লাভে

যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসকে পৃথিবীর অন্যতম প্রভাবশালী গণমাধ্যম বিবেচনা করা হয়। ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট তারা ‘ত্রৈমাসিক সাবস্ক্রিপশন’ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে জানায়, কোয়ার্টার ২ তে তাদের ডিজিটাল অনলি (শুধুমাত্র ডিজিটাল সাবস্ক্রাইবার) যুক্ত হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার। গণমাধ্যমটি তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, এই সংখ্যা তাদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি।

বর্তমানে নিউইয়র্ক টাইমসের মোট ‘ডিজিটাল-অনলি’ সাবস্ক্রাইবার ১ কোটি ১৩ লাখ (১১.৩০ মিলিয়ন)। এর মধ্যে প্রায় ৬.০২ মিলিয়ন ব্যবহারকারী একাধিক প্রোডাক্ট বা বান্ডল সাবস্ক্রিপশন ব্যবহার করেন। প্রিন্ট সংস্করণসহ মোট সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১৮ লাখ ৮০ হাজার (১১.৮৮ মিলিয়ন)। এটি ২০২৫ সালের আগস্ট মাসের তথ্য। কোম্পানির লক্ষ্য ২০২৭ সালের মধ্যে ১ কোটি ৫০ লাখ সাবস্ক্রাইবারে পৌঁছানো।

মুনাফা: এই ত্রৈমাসিকে নিউইয়র্ক টাইমসের মোট রাজস্ব বেড়েছে ৯.৭ শতাংশ, যা দাঁড়িয়েছে ৬৮৫.৯ মিলিয়ন ডলারে। প্রতি শেয়ারে সমন্বিত মুনাফা ৫৮ সেন্ট, যা অনুমিত ৫০ সেন্টের চেয়ে বেশি।

ডিজিটাল বিজ্ঞাপন আয় বেড়েছে ১৮.৭ শতাংশ, মোট ৯৪.৪ মিলিয়ন ডলার। ডিজিটাল-অনলি গ্রাহক প্রতি গড় আয় বেড়ে হয়েছে ৯.৬৪ ডলার, যা ৩.২ শতাংশ বৃদ্ধি নির্দেশ করে।

কীভাবে এই সাফল্য: সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে নিউইয়র্ক টাইমস এই সাফল্য পাচ্ছে। এমনিতে তাদের সংবাদ, অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু আয় বাড়াতে কনটেন্ট স্ট্র্যাটেজি অন্যদের চেয়ে কিছুটা আলাদা। মূল নিউজ কনটেন্টের পাশাপাশি তারা স্পোর্টস প্ল্যাটফর্ম The Athletic, গেম Wordle এবং প্রোডাক্ট রিভিউ সাইট Wirecutter-এর মাধ্যমে নতুন পাঠক টানছে। প্রিমিয়াম খাত থেকে আয় বাড়াতে মূলত তারা লাইফস্টাইল কনটেন্টে বেশি জোর দিয়েছে। তাদের লক্ষ্য হলো এমন ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করা, যারা শুধুমাত্র খবর নয়, লাইফস্টাইলকেন্দ্রিক কনটেন্টেও আগ্রহী।

এই মডেলকে ‘লাইফস্টাইল+জার্নালিজম’ কৌশল বলা যেতে পারে। গণমাধ্যমটি বুঝেছে, আজকের তরুণ ও মধ্যবয়সী পাঠকরা নিউজ পড়তে নয়, ‘এক্সপেরিয়েন্স নিতে’ আসে। তাই তারা নিউজের সঙ্গে লাইফস্টাইল কনটেন্ট যুক্ত করেছে। যেখানে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক খবরের পাশাপাশি রয়েছে ব্যক্তিগত জীবন, স্বাস্থ্য, ফুড, গেমস এবং শিক্ষা বিষয়ক কনটেন্ট।

‘ইনফরমেশন’-এর সঙ্গে ‘ইন্টারঅ্যাকশন’ মিশিয়ে পাঠকের সময় ধরে রাখছে। এটি একধরনের ‘ইমারসিভ জার্নালিজম’ বা ‘লাইফস্টাইল-নিউজ হাইব্রিড মডেল’, যা প্রচলিত নিউজরুমের ধারণাকে ভেঙে নতুন আয়ের পথ তৈরি করেছে।

বাংলাদেশে ‘সংবাদ মানে ফ্রি’ এই প্রবণতা প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ‘প্রিমিয়াম কনটেন্ট’ এখানে দুঃস্বপ্নের মতোই বলা চলে। অথচ বাংলাদেশের ওটিটি প্ল্যাটফর্মের পেইড ভার্সনে নাটক-সিনেমা দেখার প্রবণতা দিনকে দিন বাড়ছে। মার্কেট খুঁজে পাচ্ছে না শুধু গণমাধ্যম।

অন্যদিকে দ্য গার্ডিয়ানের ক্ষেত্রে আমরা দেখি ‘ভালো সাংবাদিকতা’ টিকিয়ে রাখতে বিশ্ববিখ্যাত এই প্রতিষ্ঠানগুলো কখনো প্রিমিয়াম কনটেন্ট বিক্রি করে (সাবস্ক্রিবশন মডেল), কখনো আবার সরাসরি ডোনেশন বা মেম্বারশিপ মডেল চালু করে। এসব প্রক্রিয়ায় তারাও ভালোভাবেই টিকে যাচ্ছে। মানুষ ডলার বা পাউন্ড খরচ করে তাদের ওয়েবসাইট সাবস্ক্রাইব করে টেক্সট নিউজ পড়ছে। এএফপি, রয়টার্সের মতো এজেন্সি টেক্সটের পাশাপাশি ভিডিও ফুটেজ বিক্রি করছে। এটি ‘সিন্ডিকেশন ইকনোমি’ নামে পরিচিত।

বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে

বাংলাদেশে ‘সংবাদ মানে ফ্রি’ এই প্রবণতা প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ‘প্রিমিয়াম কনটেন্ট’ এখানে দুঃস্বপ্নের মতোই বলা চলে। অথচ বাংলাদেশের ওটিটি প্ল্যাটফর্মের পেইড ভার্সনে নাটক-সিনেমা দেখার প্রবণতা দিনকে দিন বাড়ছে। মার্কেট খুঁজে পাচ্ছে না শুধু গণমাধ্যম।

বাংলাদেশি মিডিয়া মার্কেটের প্রধানতম আয়ের উৎস স্থানীয় কোম্পানির বিজ্ঞাপন। কিন্তু সরকার পরিবর্তন হলে গণমাধ্যমভেদে বিজ্ঞাপন পাওয়ার হার কমে যায়। মিডিয়ার ওপর ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’ এতটাই প্রভাব ফেলে যে প্রতিষ্ঠান টেকানো দায় হয়ে পড়ে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের।

ডিজিটাল বনাম প্রিন্ট

যেসব প্রিন্ট পত্রিকা এবং টেলিভিশনের ডিজিটাল মাধ্যমে জনপ্রিয়, তারা খুব একটা লাভ না করলেও তাদের লোকসান বা ভর্তুকির হার তুলনামূলক কম। কিন্তু যাদের প্রিন্ট নেই, স্যাটেলাইটও নেই শুধু নিউজ পোর্টাল, তারা অনেকেই লোকসানে।

নিউজ পোর্টালগুলো যতই জনপ্রিয় হোক না কেন, স্থানীয় কোম্পানি বিজ্ঞাপনের রেট বাড়াতে চায় না। অনেক ক্ষেত্রে প্রিন্ট না থাকলে বিজ্ঞাপনই দিতে চায় না। স্থানীয় কোম্পানির এই দ্বিচারিতা ঠেকাতে সরকার আলাদা নীতিমালা না করলে ডিজিটাল মিডিয়ার ভবিষ্যৎ সামনে আরও খারাপ হবে। গুণগত মান কমে যাবে। এতে রাষ্ট্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ আরও হেলে পড়বে।

এই পরিস্থিতি আসলে ‘ট্রাস্ট ইকোনমির’ সংকট, যা গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় বিরাজমান। বিজ্ঞাপনদাতারা এখনো ‘প্রিন্ট ও টিভিকে বেশি বিশ্বাসযোগ্য’ মনে করেন। ফলে ডিজিটাল মিডিয়া অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে যায়।

স্ট্যাটিসটিয়ার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এই খাতের সবচেয়ে বড় অংশ এখনো প্রিন্ট সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন, যার বাজারমূল্য (২০২৫ সাল নাগাদ) প্রায় ২২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

নিউজ পোর্টালগুলোর লোকসানের আরেকটি বড় কারণ ‘টেক্সট নিউজ’ সেল করতে না পারা। নিউজকে যদি পণ্য ধরি, তাহলে তার গুণাগুণ (নিরপেক্ষতা ও গভীরতা) ঠিক রেখে বিক্রি করার মতো গুণমান অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের নেই। এজন্য প্রিমিয়াম কনটেন্ট পদ্ধতি এখনো অলীক ভাবনা।

এখানে যুক্তির খাতিরে নিউজকে পণ্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আমি জানি, সাংবাদিকতা কখনোই পণ্য হতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশের মিডিয়া-বিনিয়োগকারীদের এটা বোঝানো কঠিন। তারা বিনিয়োগের কয়েক মাসের মধ্যেই রিটার্ন চেয়ে সম্পাদকদের ঘুম নষ্ট করে দেন। একটা বছরও সময় দিতে চান না।

লিডারশিপে অজ্ঞতা

ডিজিটাল মিডিয়া বিষয়ক কনসালটেন্সি করতে গিয়ে আমি দেখেছি আমাদের সিনিয়র সাংবাদিকেরা টেকনিক্যালি এতটাই দুর্বল যে তাদের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন। তারা হয়তো সনাতনী সাংবাদিকতায় দারুণ, কিন্তু ডিজিটাল মিডিয়া দাঁড় করাতে পারছেন না।

এই প্রবণতাকে আধুনিক যুগে ‘লিগ্যাসি মিডিয়া ইনারশা’ বলা হয়। অর্থাৎ পুরোনো পদ্ধতির সাংবাদিকরা নতুন প্রযুক্তি ও অ্যালগরিদম নির্ভর নিউজ ইকোনমি বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

ভালো সাংবাদিকতা করেও প্রবীণরা যখন ডিজিটালে প্রচার-প্রসার বাড়াতে পারছেন না, তখন প্রকাশক বা বিনিয়োগকারী এমন ব্যক্তিদের কাছে যাচ্ছেন, যারা নৈতিকভাবে ‘গুজব সাংবাদিকতা’ বা ‘ক্লিকবেইট’-এর অভিযোগে বিদ্ধ। তখন সামনে আসে ‘ভিউ ইকোনমি’।

অথচ সত্য হলো, টেকনিক্যালি সাউন্ড হলে সনাতনী সাংবাদিকতা দিয়েই প্রচার-প্রসার বাড়ানো সবচেয়ে সহজ। যাদের প্রেজেন্টেশন ভালো, টেক্সট নিউজ শক্ত, সেই প্রতিষ্ঠানের টিম লিডার প্রযুক্তিতে দক্ষ হলে তারাই সহজে ‘ভিউ ইকোনমি’তে টিকে থাকতে পারেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে এখনো এমন ব্যক্তিদের রাখা হয়, যারা নিজেদের অজান্তেই ডিজিটাল নিউজরুমের পরিবেশ নষ্ট করছেন। তারা শিখতেও চান না।

টেক্সট নিউজ বনাম ভিডিও নিউজ

কোনটিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত-এই দ্বিধা এখনো অনেক সম্পাদক ও প্রকাশকের কাটেনি। কেউ কেউ মনে করেন টেক্সট নিউজ ওয়েবসাইটের প্রাণ। কিন্তু আমরা বহু গবেষণায় দেখছি, টেক্সট পড়ার প্রবণতা দিন দিন তলানিতে নামছে।

তবুও বাস্তবতা হলো, টেক্সট দুর্বল রেখে ভিডিও কনটেন্টে নজর দিলে পোর্টালের সাংবাদিকতাগত ও বৌদ্ধিক মূল্য অনেক কমে যায়। আবার টেক্সটে বেশি বিনিয়োগ করলে আয় আসে না। এই দোটানার কারণে অনেক ডিজিটাল মিডিয়া দীর্ঘমেয়াদে অস্থির হয়ে পড়ে।

গুগল অ্যাডসেন্স ও ফেসবুক ইনস্ট্যান্ট আর্টিকেল থেকে একসময় ভালো আয় হতো। এখন সেটিও অনিশ্চিত। মেটা ও গুগল প্রায় প্রতিবছর কনটেন্ট নীতিমালা ও রাজস্ব কাঠামো পাল্টায়। তাই এসব মাধ্যমে ভর করেও টেকা যাচ্ছে না।

টেক্সট নিউজ সেল করার আরও কিছু উপায় আছে, যা বড় প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ছাড়া সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে কনটেন্ট হতে হয় শতভাগ ইউনিক।

নিউজ পোর্টালগুলো যতই জনপ্রিয় হোক না কেন, স্থানীয় কোম্পানি বিজ্ঞাপনের রেট বাড়াতে চায় না। অনেক ক্ষেত্রে প্রিন্ট না থাকলে বিজ্ঞাপনই দিতে চায় না। স্থানীয় কোম্পানির এই দ্বিচারিতা ঠেকাতে সরকার আলাদা নীতিমালা না করলে ডিজিটাল মিডিয়ার ভবিষ্যৎ সামনে আরও খারাপ হবে। গুণগত মান কমে যাবে।

এতটুকু পড়ে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, প্রতিষ্ঠানের টপ ম্যানেজমেন্ট এসবে ‘আপ-টু-ডেট’ না হলে টিকে থাকা কঠিন। টেক্সট নিউজকে প্রিমিয়াম করতে হলে কনটেন্ট হতে হবে নিশ-স্পেসিফিক। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় এমন জায়গায় পৌঁছাতে হবে, মানুষ কিনতে বাধ্য হবে।

এছাড়া বিজনেস, এডুকেশন, এনভায়রনমেন্ট, টেক ইত্যাদি নির্দিষ্ট পাঠকগোষ্ঠী টার্গেট করেও মাইক্রো-পেওয়াল মডেল চালু করা যায়। কিন্তু ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস’ মানে পৌঁছানোর মতো প্রশিক্ষিত লেখক/ক্রিয়েটর আমাদের বাজারে খুব কম।

নাগরিক সাংবাদিকতায় ধরাশায়ী মূলধারার গণমাধ্যম

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিনামূল্যে তথ্যের যে বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে, তাতেই এখন পাঠকের চাহিদা মিটে যায়। বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যম যখন বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় তলানিতে, তখন নাগরিক সাংবাদিকতা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।

এটি ‘ডিসইন্টারমিডিয়েশন অফ জার্নালিজম’ নামে পরিচিত। অর্থাৎ সাংবাদিকতার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানকে পাস কাটিয়ে ব্যক্তি নিজেই নিউজ উৎস হয়ে উঠছে।

এইরকম অসংখ্য উদাহরণ আমাদের আশেপাশে। তারা মূলধারার মিডিয়ার 'গেটকিপিং' ছাড়াই জনগণের কাছে তথ্য পৌঁছে দিচ্ছেন। একদম বিনামূল্যে।

আর কী করা যেতে পারে

নিউইয়র্ক টাইমসের পাশাপাশি ফ্রান্সের Le Monde এবং স্পেনের El País প্রিমিয়াম কনটেন্টে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সবচেয়ে সফল হয়েছে। তারা মিশ্র কৌশল অবলম্বন করেছে। কেউ কঠোর পেওয়াল, কেউ হাইব্রিড মডেল (যেখানে কিছু খবর নিবন্ধন করলে ফ্রি, বাকি অংশ সাবস্ক্রাইবারদের জন্য), আবার প্রিমিয়াম মডেল ব্যবহার করছে ট্যাবলয়েড ধাঁচের মিডিয়া (Bild, VG), যেখানে কম মূল্যের সাবস্ক্রিপশন + বিজ্ঞাপনের রাজস্ব মিলিয়ে লাভ হচ্ছে।

এই কৌশলগুলো তাদের একইসঙ্গে ‘বিনামূল্যের পাঠক’ ও ‘প্রিমিয়াম পাঠক’ দুই গ্রুপকেই ধরে রাখতে সাহায্য করছে।

সফল প্রতিষ্ঠানগুলো তিনটি জিনিসে মিল রেখেছে: শক্তিশালী কনটেন্ট আইডেন্টিটি, একাধিক প্রোডাক্ট বা বান্ডল অফার এবং লক্ষ্যভিত্তিক পাঠক এনগেজমেন্ট।

রয়টার্স ইন্সটিটিউটের ডিজিটাল রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, মাত্র ১৭ শতাংশ মানুষ অনলাইন নিউজের জন্য টাকা দিতে রাজি এবং ৫৭ শতাংশ একেবারেই দিতে চায় না।

তবু আশা আছে। কিছু কৌশল ইতিমধ্যে ব্যবহার হচ্ছে, যা ভবিষ্যতের দিক নির্দেশ করে: দীর্ঘ বা সস্তা ট্রায়াল পিরিয়ড (যাতে নতুন পাঠক অভ্যস্ত হয়), মাল্টি-ব্র্যান্ড বান্ডল অফার (একসঙ্গে একাধিক মিডিয়া কনটেন্ট), নন-নিউজ ফিচার, যেমন গেমস, রেসিপি, পাজল এবং বিভিন্ন দামের সাবস্ক্রিপশন টিয়ার (কম দামের ডিজিটাল এডিশনসহ)।

এইসব কৌশল নতুন পাঠক টানতে সহায়ক হলেও, এর ভেতরে আবার ঝুঁকি আছে। প্রায় ৪১ শতাংশ সাবস্ক্রাইবার আসলে ডিসকাউন্টেড, অর্থাৎ পূর্ণ দাম দিতে চায় না।

এসব পেরিয়ে পাঠককে টাকা দিতে রাজি করাতে হলে নিউজ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজেদের ‘মূল্য’ প্রমাণ করতে হবে। এমন সাংবাদিকতা তৈরি করতে হবে যা অনুসন্ধানী, বিশ্বাসযোগ্য  এবং জীবনের অংশ হিসেবে দরকারি।

নিউজরুমকে ভাবতে হবে এক ধরনের কনটেন্ট ইনোভেশন ল্যাব হিসেবে, যেখানে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির পাশাপাশি কাজ করবে কনটেন্ট স্ট্র্যাটেজিস্ট, প্রোডাক্ট ম্যানেজার, অ্যানালিটিকস টিম এবং ব্র্যান্ড পার্টনারশিপ বিশেষজ্ঞরা। ‘ভালো সাংবাদিকতা’ হবে আলোর মতোই এক প্রিমিয়াম পণ্য। নিউজ নিজেই হয়ে উঠবে এক ‘ভ্যালু প্রোডাক্ট’।

তথ্যসূত্র:

১। https://www.statista.com/outlook/amo/media/bangladesh

২। https://www.reuters.com/business/new-york-times-subscriptions-boosted-by-bundling-news-lifestyle-content-2025-08-06

৩। https://reutersinstitute.politics.ox.ac.uk/digital-news-report/2024?utm_source=chatgpt.com

অমৃত মলঙ্গী : ভয়েস অফ আমেরিকার সাবেক বাংলাদেশি কন্ট্রিবিউটর; এআই ও ডিজিটাল মিডিয়া ট্রেইনার, নেটকম লার্নিং

amritamalangi@gmail.com



ধ্রুবকন্ঠ | Dhruba Kantho

“তারুণ্যের সংবাদ মাধ্যম”

কপিরাইট © ২০২৫ ধ্রুবকন্ঠ | Dhruba Kantho । সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত