রাজনীতি

খালেদা জিয়া যেন উলুবনে একজন মুক্তা

-মুজতবা খন্দকার

এই পোড়া দেশে খালেদা জিয়ার মতো নেতার জন্ম হওয়া ঠিক হয়নি। যে দেশে নেতা আছে, দেশ প্রেমিক নেই। যে দেশে শোষক আছে প্রকৃত জনপ্রতিনিধির বড্ড অভাব। সে দেশে বেগম খালেদা জিয়া যেন উলুবনে একজন মুক্তা। সেদিন হঠাৎ অনেকদিন পর তাঁর সাথে দেখা। সিঁড়িতে। তার অফিস আমাদের বিল্ডিংয়ের কয়েক তলা উপরে। একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের বাংলাদেশ ব্যুরো চীফ। বললেন,জিয়া হাসানের ওপর হঠাৎ ক্ষেপলেন কেন? আমি কিছু জবাব দেয়ার আগে তিনি বললেন,খালেদা জিয়াকে সবার স্যালুট করা উচিৎ। কারন আজকে দেশ যে ভীতের ওপর দাঁড়িয়ে সরকার উন্নয়নের গল্প রিলে রেসের মতন প্রতিদিন দীর্ঘ করছে,তাঁর বুনিয়াদটা কিন্ত খালেদা জিয়ার ১৯৯১-৯৬ ও পরবর্তীতে ২০০১-২০০৬ সরকার তৈরী করে দিয়ে গেছে। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, আজকে দেশ যে অবস্থানে পৌঁছেছে তার পেছনে একমাত্র খালেদা জিয়া। তাঁর হাজারটা দোষ থাকতে পারে। কিন্তু দেশে আজকে যে গণতন্ত্র সেটা একমাত্র তার জন্য এসেছিলো। তিনি মুহুর্তে শুধরে নিয়ে বললেন,দেশের মানুষ যে গণতন্ত্রের জন্য হাপিত্যেষ করছে,সেটার আকাংখা বেগম খালেদা জিয়াই সবার মনে উপলব্দি করার বোধ এনে দিয়েছিলেন। তিনি দেশে গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরী করে দিয়েছিলেন,বলে,এখন আমরা বুঝতে পারি গণতন্ত্রের অভাব। বুঝতে পারি আমরা গণতন্ত্রহীনতার দেশে বাস করছি। দেশে এক সময় খালেদা জিয়া,তারেক রহমান এবং বিএনপির মন্ত্রীসভার সদস্যদের নিয়ে প্রতিদিন প্রথম আলোসহ অনেক পত্রিকায় নানা রকমের এখন সে কার্টুন কোথায়? কই সে জন্য তো কোনোদিনই বেগম জিয়া সংশ্লিষ্ট পত্রিকার সম্পাদকদের ডেকে পাঠান নি,কৈফিয়ত চাননি। গণতন্ত্রটা কি সেটা বেগম জিয়াই আসলে অনুশীলন করেছেন। এখন শিশির ভট্টাচার্য কোথায়?

বেগম খালেদা জিয়া সরকারের প্রথম মন্ত্রীসভা ছিলো জিয়াউর রহমানের মন্ত্রীসভার অনেকটা হুবহু সম্প্রসারিত রুপ। সাইফুর রহমানের মতন একজন ভীশনারী চার্টার্ডকে তিনি অর্থমন্ত্রী করেছিলেন। যিনি চিরাচরিত রক্ষনশীল অর্থনীতির ঢাকগুড়গুড় ইমেজ ভেঙ্গে দেশের অর্থনীতির খোলনলচে বদলে দেয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন। বেগম জিয়া তাকে সেই স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তিনি যত্রতত্র ব্যাংক বিমার লাইসেন্স দেয়ার বিরোধী ছিলেন। বলতেন, ছোট্ট একটা দেশ। এতগুলো রাষ্ট্র্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি আরো আরো ব্যাংক বীমা খুললে,সেগুলো চলবে কিভাবে? সাইফুর রহমানের সময়ে দলীয় পরিচয়ে কোনো ব্যাংক বীমা খোলার লাইসেন্স দেয়া হয়নি,হাজার কোটি তো দুরের কথা,জনগনের হাজারটাকাও কেউ মেরে দিব্যি ফুরফুরে মেজাজে বুক ফুলিয়ে চলতে পারেনি। অর্থনৈতিক সেক্টরে শৃংখলা তার সময়ের চেয়ে আর ভালো কখনো ছিলোনা। আর এটা সম্ভব হয়েছিলো। একজন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বলে।

বেগম জিয়া,দেশের কথা ভাবতেন,দেশের জনগনের কথা তিনি উপলব্দি করতেন বলে,গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে এসেছিলেন,তার ধমনীতে রাজনীতি ছিলোনা। কিন্তু তিনি মাঠে শিখেছেন,জনগনের ভালোবাসা পেয়েছেন। তিনি যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা সংশয়ে থাকতেন। বহু আলোচনা করতেন,কিন্তু একবার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে,সেটা থেকে তাকে সরানো ছিলো পাহাড় ঠেলে ফেলার মতো ব্যাপার।

স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি যদি বিন্দুমাত্র এদিক,ওদিক করতেন তবে অত সহজ ছিলোনা এরশাদকে হটানোর। কারন পনেরদলের শীর্ষ নেতারা তখন এরশাদের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। আর তথাকথিত বাম পাঁচদল তো পনেরোদলের কাছেই জিম্মি। সুতরং বাকি ছিলো শুধু বিএনপি। সেখানেও ভাঙ্গন ধরাতে কম কসরত করেনি এরশাদ। কিন্তু বেগম অটুট,ইস্পাত দৃঢ় প্রত্যয় বার বার এরশাদের পরিকল্পনাকে ভেস্তে দিয়েছে। সুতারং আজ,বেগম জিয়াকে না জেনে, তাকে না বুঝে এখন অনেকেই তার প্রতি নির্দয় আচরণ করছে।

মঈন ফখরুদ্দীনের সময়টায় আসুন। দেখুন তার সিদ্ধান্তগুলো কত ম্যাচুউরড ছিলো। সিইসি শামসুল হুদা বিএনপিকে ভাঙ্গতে চেয়েছিলেন। মঈন,মাসুদ উদ্দীন আর ফখরুদ্দীনের ফরমায়েশিতে। (পরবর্তীতে শামসুল হুদাকে আমি একটা টকশোতে একক গেষ্ট হিসেবে আনি। আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর আগে,কথাপ্রসঙ্গে তিনি আমার কাছে স্বীকা্র করেছিলেন, সেটা তিনি চাপে করতে বাধ্য হয়েছিলেন।)
বেগম জিয়া সেটা আঁচ করতে পেরেছিলেন,দলের সাধারন সম্পাদক মান্নান ভুইয়া বিট্রে করলেন, আর বর্ষিয়ান নেতা,সাইফুর রহমান,যাকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে পার্টির সেক্রেটারী করলেন খালেদা জিয়া, ছিলেন,জিয়ার ক্যাবিনেটে স্বরাষ্ট্র পরে বানিজ্যমন্ত্রী তাকে হুমকী দিলেো বিএনপির চেয়ারম্যান হবার। আমরা তো জানি,সেদিন গুলশানের জালালাবাদ হাউজে সাইফুর রহমানকে কিভাবে হুমকী দেয়া হয়েছিলো। আমরা তখন মাঠের রিপোর্টার। তিনি সেদিন,দু:খ করে বলেছিলেন, আমি কিতা করতাম!

বেগম জিয়া বুঝেছিলেন সব,তাই জেলে যাবার আগে দলের পোড় খাওয়া পরিক্ষিত নেতা খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিব ঘোষনা করে গিয়েছিলেন,সেটা যে কত দুরদর্শী সিদ্ধান্ত ছিলো,এখন বিএনপির নেতাকর্মীরা বোঝেন। প্রয়াত হান্নান শাহ আর খোন্দকার বিএনপি নামক দলটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। বেগম জিয়াকে জেলে নেবার পর কত টোপ এসেছে। ছেলেদের মেরে ফেলার হুমকী দেয়্ হয়েছে। কিন্তু তিনি টলেননি। তিনি দেশ ছেড়ে যাবার কখনো কোনো তাগাদা অনুভব করেননি। পক্ষান্তরে অন্য নেতা কী করেছেন, তিনি সুড় সুড় করে বিদেশে চলে গেছেন অথচ এক পর্যায়ে তার জন্য দেশের সব পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভাগ্য ভালো তার একজন পাবরিবারিক বন্ধু প্রনব মুখার্জি ছিলেন,আর ভাগ্যচক্রে তিনি তখন বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের রাষ্ট্রপতি!

কিন্তু বেগম জিয়ার পাশে সেদিন কেউ ছিলোনা,কেউ না। শুধু ভরসা করেছিলেন দেশের জনগনের প্রতি। আজো তার ভরসা সেই জনগন। তাঁকে যখন কথিত দুর্নীতি মামলায় জেলে নেয়া হলো। যাবার সময় তিনি নির্দেশ দিয়ে গেলেন। তার মুক্তি কিম্বা তাঁর জেল গমনের প্রতিবাদে কোনো আন্দোলন দরকার নেই।

এমন একজন মহান নেতার বিরুদ্ধে যারা বিষোদাগার করে,আসলে তাদের প্রতি করুনা করতে ইচ্ছে হয়,কবি আবদুল হাকিমের ভাষায় বলতে হয়,এদের কাহার জন্ম নির্নয় না জানি!

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বেগম জিয়ার কাছের মানু্ষ ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। তার বয়ানে চলুন বেগম জিয়া সম্পর্কে কিছু শুনি.. বেগম জিয়ার সাথে রাজনীতি করে ব্যক্তি হিসেবে তাঁর বেশ কতগুলো অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাই। রাজনৈতিক স্মৃতিকথায় একজন কুন্ঠিত লেখক হিসেবে সেসব কথা লিখতে গিয়ে আমি বেশী উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে চাইনা।

আমি বরাবরই দেখেছি বেগম জিয়া কখনোই হঠাৎ করে কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে আসেননা। উদ্ভুত সমস্যা নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা ও চর্চা চালান তিনি। যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন,তখন সেই বিষয় থেকে তাঁকে সরানো একেবারেই মুশকিল হয়ে পড়ে।

তাঁর সাথে “আপোসহীন” উপমা এমনিতেই সম্পৃক্ত হয়নি। আমি অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছি, দেশবাসীর সতষ্ফুর্ত দেয়া এই খেতাব কতো বেশী যর্থাথ কতো বেশী সত্য।

একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হিসেবে তিনি সুখেই তাঁর দিনগুলো অনায়াসেই কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি নীতিগত কারণেই দেশবাসীর সাথে জড়িয়ে পড়লেন এবং বলা চলে তাঁর একক নেতৃত্বেই আপোসহীনভাবে এগিয়ে চলে স্বৈরাচারবিরোধী সেই আন্দোলন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button