হবিগঞ্জের ব্যাংকিং খাতে নজিরবিহীন অর্থ সংকট দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন শত শত আমানতকারী তাদের সঞ্চিত অর্থ তুলতে ব্যাংকের শাখাগুলোতে এসে ফিরে যাচ্ছেন খালি হাতে। মফস্বল শহরের শাখাগুলোতে এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করায় স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কৃষিখাতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, কেন্দ্রীয় শাখায় অর্থ স্থানান্তরের চাপ এবং আঞ্চলিক ঋণ বিতরণে অনীহা এই সংকটের মূল কারণ।
এই যেমন_ বাহুবল উপজেলার কলেজশিক্ষক জামাল উদ্দিন। ছোটভাইকে ইতালি পাঠানোর সকল প্রস্তুতি তার শেষ। কিন্তু গত তিনমাস ধরে ইউনিয়ন ব্যাংকের বাহুবল শাখায় ঘুরেও জমানো টাকা তুলতে পারছেন না। ফলে ছোটভাইয়ে স্বপ্নের ইউরোপযাত্রা নিয়ে এখন দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমার ছোটভাইকে ইতালি পাঠাব। এর জন্য ১০ লাখ টাকার এফডির ভেঙে ফেলেছি। কিন্তু ব্যাংক থেকে টাকা দিতে পারছে না। ছোটভাইকে ইতালি পাঠানোর জন্য অলরেডি আমি কয়েক লাখ টাকা খরচ করে ফেলেছি। কিন্তু ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে না পারায় বাকি টাকা দিতে পারছি না। এখন তার ভিসা বাতিল হওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে।’
জেলার ইউনিয়ন ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংকসহ বেসরকারি অধিকাংশ ব্যাংকেই এমন অর্থসংকট। ব্যাংকগুলোতে প্রতিদিনই ভীড় করছেন আমানতকারীরা। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোন টাকা দিতে পারছে না। অধিকাংশ ব্যাংক গ্রাহকদের সপ্তাহে অথবা মাসে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা দিচ্ছে।
ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে না পারায় এর প্রভাব পড়ছে স্থানীয় অর্থনীতি ও কৃষিখাতে। গত মৌসুমের ধান বিক্রি করে অনেক কৃষক ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন। চলতি বোরো মৌসুমে সেই টাকা তুলতে না পারায় চাষাবাদ নিয়ে বেড়েছে দুশ্চিন্তা।
বাহুবলের বাসিন্দা অনু মিয়া বলেন, ‘আমি ৫৫ লাখ টাকা দিয়ে একটি বাসা বিক্রি করি। পরে এক ছেলে ও এক মেয়েকে লেখাপড়া করতে ইউরোপ পাঠানোর জন্য ৪০ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা রেখেছিলাম। কিন্তু এখন ছেলে-মেয়েকে পাঠাব কিন্তু তিনমাস ঘুরেও টাকা তুলতে পারছি না। তারা আমাকে ৫ হাজার ১০ হাজার টাকা দেয়।’
গৃহীনি আছিয়া বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী নেই, নিজেও কিছু করি না। আমার স্বামীর পেনশনের টাকাই একমাত্র সম্বল। এই টাকা দিয়ে পরিবারের ভরন-পোষণ এবং দুই ছেলে মেয়েকে ঢাকায় লেখাপড়া করাই। কিন্তু এখন ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে না পারায় ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া ও থাকা খাওয়ার টাকা পাঠাতে পারছি না। সংসার চালাতে হচ্ছে ঋণ করে ‘।
হবিগঞ্জ শহরের ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ন্যাশনাল ব্যাংকে আমার টাকা। কিন্তু ব্যাংক টাকা দিচ্ছে না। যে কারণে দোকানে নতুন পণ্য তুলতে গিয়েছিলেন। এভাবে চললে কিছুদিন পরে হয়তো ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।’
ব্যাংক কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে, মফস্বল শহরে শাখাগুলোর তারল্য সংকটের কিছু কারণ চিহ্নিত করা গেছে। মূলক, ব্যাংক পরিচালনায় ভুল পদক্ষেপ ঝুঁকিতে ফেলেছে মফস্বল শাখাগুলোকে। একই সাথে স্থানীয় শাখা থেকে কেন্দ্রীয় শাখায় মাত্রাতিরিক্ত অর্থ স্থানান্তর এবং আঞ্চিলিক ঋণ বিতরণে ব্যাংগুলোর অনিহা এই সংকটের প্রধান কারণ। যে কারণে বর্তমানে আমানতকারীদের অর্থ প্রদানে কেন্দ্রীয় শাখায় হাত পাততে হচ্ছে তাদের।
ইউনিয়ন ব্যাংকের বাহুবল শাখার ব্যবস্থাপক মোজাক্কির হোসেন বলেন, ‘এই সংকট সাময়িক এবং খুব শিগগিরই সমাধান হবে। কিন্তু এখনতো আমরা বেকায়দায় পড়ে গেছি। প্রতিদিন গ্রাহকরা আসছেন টাকা নিতে, কিন্তু দিতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘বাহুবলের মধ্যে আমার শাখাটি ছির একটি বেস্ট শাখা। কিন্তু এখন আমরা ইমেজ সংকটে পড়েছি। প্রতিদিন যেখানে ৭০-৮০ লাখ টাকা দরকার, সেখানে কেন্দ্রীয় শাখা থেকে পাচ্ছি মাত্র ২ লাখ টাকা।’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমাদের স্থানীয় শাখায় পর্যাপ্ত টাকা সংরক্ষণ করার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। কেন্দ্রীয় শাখা থেকে নিয়মিত অর্থ সরবরাহ না পেলে, এই সংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে।’
ন্যাশনাল ব্যাংকের হবিগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের শাখায় বেশিরভাগ আমানতকারীর টাকা আটকে গেছে। গ্রাহকদের মাসে ১০ হাজার টাকা করে দিতে পারছি। এছাড়া উপায় নেই।’
তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি এবং নির্দেশনা সঠিকভাবে অনুসরণ করলেই এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। আমরা গ্রাহকদের বলছি ধৈর্য ধরতে, শীঘ্রই সমস্যার সমাধান হবে।’
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ব্যাংক পরিচালনায় গাফিলতি এবং কেন্দ্রীয় তদারকির অভাবে এমন সংকট তৈরি হয়েছে। স্থানীয় শাখাগুলোতে নগদ অর্থের অভাব দেখা দেওয়ার মূল কারণ হলো কেন্দ্রীয় শাখায় মাত্রাতিরিক্ত অর্থ স্থানান্তর। ব্যাংকগুলো যদি মফস্বল শাখাগুলোর জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত না করে, তাহলে স্থানীয় অর্থনীতি আরও বিপর্যস্ত হতে পারে। এজন্য দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’