শুধু ওজন মাপার কাজই কি করেন তারা?
গড়ে প্রতিদিন ৩০০–৪০০ টাকা আয় হলেও শুক্রবারে তা বেড়ে ৬০০–৮০০ টাকায় দাঁড়ায়।
পথে হাঁটতে হাঁটতে কখনো কি আপনার চোখ পড়েছে ওজন মাপার মেশিন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মানুষ? রাস্তার ধারে, পার্কের প্রবেশপথে, অথবা কোনো ব্যস্ত বাজারের মোড়ে প্রায়ই দেখা যায় তাদের। পথচারীদের ওজন মাপার বিনিময়ে জীবিকার একটি পথ তৈরি হয় এই মানুষগুলোর।
হয়তো পাঁচ-দশ টাকায় আপনিও মেপে নেন নিজের ওজন। এই মেশিনটিই তাদের জীবিকা। প্রতিদিন অসংখ্য পথচারী কৌতূহলবশত তাদের কাছে থামেন, ওজন মাপেন। যারা স্বাস্থ্যসচেতন, তারা তো নিয়ম করেই ওজন মাপেন।
রোদ-বৃষ্টি, ধুলোবালি, শীত কিংবা তাপ—যা-ই আসুক, শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে থাকা এই মানুষগুলো বসে থাকেন পথচারীর আশায়। কেউ যদি একবার মেশিনের দিকে চোখ ফেলেন, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় তাদের আকুতি, ‘একটু ওজন মাইপা যান’, ‘হাইটও মাপা যাইব।’
এই যে তাদের কাজ, এটিই কি তাদের আয়ের একমাত্র পথ? আমার মতো আপনারও মাথায় এমন প্রশ্ন আসতে পারে। এর উত্তর এবং তাদের অজানা জীবন জানতে শহরতলীর অলিগলি এবং পার্কে ঘুরে ঘুরে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড কথা বলেছে এই মানুষগুলোর সঙ্গে।
বিকেল হলেই ওজন মাপার মেশিন নিয়ে পার্কের এক কোণায় দাঁড়িয়ে পড়েন মো. সিদ্দিক হোসেন। পাঁচ বছর ধরে তিনি এই কাজ করছেন। নিয়ম করে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেন, যাতে পুরোনো খদ্দেররা তাকে সহজে খুঁজে পায়।
বয়স পঞ্চাশের বেশি। ঢাকার মনিপুরিপাড়ায় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে তার বাস। একটি গার্মেন্টস কোম্পানিতে কর্মরত তিনি। সেখান থেকে যা আয় করেন, তা দিয়েই সংসার চালাতে হয়।
পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বলতে কেবল তিনিই। তবে একজনের অল্প বেতনে চাল-ডাল আসলেও, প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই হাতের নাগালের বাইরে থেকে যায়। মাঝে মাঝে এই আয়ে কোনোমতে চালিয়ে নেওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে।
তাই বাধ্য হয়ে তিনি অন্য কাজের সন্ধান করতে থাকেন। ব্যবসা করার চিন্তাও আসে মাথায়। কিন্তু মূলধন নেই বলে ব্যবসা শুরু করতে পারেননি। এরপর তিনি অন্য উপায় খুঁজতে থাকেন। রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে প্রায়ই তার চোখ পড়তো ওজন মাপার মেশিন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে। তাদের কাছ থেকে কথাচ্ছলে জেনে নিতেন এই কাজের খুঁটিনাটি।
সেখান থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তিনিও করবেন এই কাজ। তারপর আর ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ নিয়ে ভাবেননি। হাজার টাকার বেশি দিয়ে কিনে নেন একটি ডিজিটাল ওজন মাপার মেশিন। তবে মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অনেক ভেবেচিন্তে এগিয়েছিলেন তিনি। কারণ এতে বেশি খরচ নেই এবং চাকরির পাশাপাশি কাজটাও চালিয়ে নেওয়া সম্ভব।
সকাল হলেই তিনি কর্মক্ষেত্রে যান। সেখানকার কাজ শেষে সন্ধ্যায় চলে আসেন চন্দ্রিমা উদ্যানে। বাড়ি থেকে কাছে বলে এই স্থানটিই বেছে নিয়েছেন তিনি। এছাড়া, এটি বেশ জনবহুল এলাকা।
রাত অবধি চলতে থাকে ওজন মাপার কাজ। রাত আটটা বা নয়টার দিকে ক্লান্ত শরীরে মেশিন হাতে বাড়ি ফেরেন। প্রতিদিনের এটি তার রুটিন। তবে বন্ধের দিনে সকাল থেকেই পার্কে থাকেন তিনি। সেদিন অন্যান্য দিনের তুলনায় আয়ও ভালো হয়। শুক্রবারে আয় সর্বোচ্চ হয়।
গড়ে প্রতিদিন ৩০০–৪০০ টাকা আয় হলেও শুক্রবারে তা বেড়ে ৬০০–৮০০ টাকায় দাঁড়ায়।
মানুষ বাড়লে আয়ও বাড়ে
১০-১২ বছর ধরে অফিসের কাজ শেষ করে অবসর সময়ে ওজন মাপার কাজ করছেন মো. গফুর (ছদ্মনাম)। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ফ্যাকাল্টিতে একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। ষাটোর্ধ্ব এই ব্যক্তি শুধুমাত্র কিছু বাড়তি আয়ের জন্য গত এক যুগ ধরে এই কাজ করে চলেছেন।
রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রতিদিন বিকেলবেলা নিয়ম করে তিনি এই কাজ করেন। এতে দিনে তার আয় হয় ৪০০-৫০০ টাকা, কোনোদিন আরেকটু বেশি। তার ভাষ্য, ‘যেদিন মানুষ বেশি থাকে, সেদিন ইনকামও ভালো থাকে।’ তবে, কোনো কোনোদিন মাত্র একশ টাকা পকেটে আসে না। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলে মানুষের আনাগোনা কমে যায়, ফলে সারাদিন বসে থেকেও তেমন লাভ হয় না।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে বেতন পান, তা দিয়ে ঠিকমতো প্রয়োজন মেটে না। তাই বয়সের ভার উপেক্ষা করে অতিরিক্ত এই কাজের দায়িত্ব নিয়েছেন। এতে যেটুকু বাড়তি আয় হয়, তা দিয়ে কিছুটা ভালোভাবে চলা যায়।
পুরো পরিবারের খরচ চালানোর পাশাপাশি ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচও সামলাতে হয় তাকে। বাসা ভাড়া, প্রয়োজনীয় চাহিদার যোগান, সংসারের নানান খরচাপাতি—এসব সামলাতে গিয়ে হিমশিম খান। তাই উপায় হিসেবে গফুরের মতো নিম্ন আয়ের অনেক মানুষই এই ধরনের কাজ বেছে নিচ্ছেন।
মো. গফুরের মতো মতিউর রহমানও ১২ বছর ধরে এই কাজ করছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের আশেপাশেই থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো জায়গায় মেশিন নিয়ে বসে পড়েন। ছেলে-মেয়েরা এসে ওজন মেপে যায়। স্বভাবে মিশুক হওয়ায় অনেকের কাছে তিনি বেশ জনপ্রিয়।
মতিউর জানালেন, ‘দিনে তার উপার্জন হয় ৪০০-৫০০ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকলে তা বেড়ে হয় ৭০০-৮০০ টাকা।’ জমানো টাকা থেকে দশ হাজারে কিনেছিলেন তার ওজন মাপার মেশিন। এখনো মেশিনটি ভালোভাবে কাজ করছে।
তার মেশিনটি লোহার হওয়ায় সহজে নষ্ট হয় না। তবে এতে শুধু ওজন মাপা যায়, তাই দামও কিছুটা কম। যে মেশিন দিয়ে ওজন এবং উচ্চতা দুটোই মাপা যায়, তার দাম ৭৬ হাজার টাকা বলে জানান তিনি। কিছুটা উৎসুক হয়ে জানতে চাইলাম, ‘এত টাকা দিয়ে মেশিন কেনার টাকাটা কি আদৌ ওঠে?’ উত্তরে এক গাল হাসি দিয়ে মতিউর বললেন, ‘লাভ না হইলে কি কেউ এত খরচা করে মেশিন কেনে, মামা?’
বাড়তি আয়ের আশায়
তিন বেলা ঠিকঠাক আহার এবং শান্তির একটি জীবনের তাগিদে মানুষ কত কিছুই না করে। অল্প বেতনে চাকরি করা এসব মানুষগুলোর কথা তো বাদই দিলাম। এমনকি, ভালো বেতনে চাকরি করা মানুষগুলোকেও দেখা যায় বাড়তি আয়ের আশায় চাকরির পাশাপাশি অন্য পেশায় নেমে পড়তে।
গফুর বা সিদ্দিকদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর না আছে সঞ্চয়, না আছে কোনো মূলধন, না আছে জমিজমা। ফলে শান্তির জীবন কাটানোর আশায় তারা বেছে নেন এমন কাজ, যা তাদের নাগালের মধ্যে থাকে। এমন কাজ, যা করতে কোনো প্রশিক্ষণ লাগে না, আবার দিনশেষে কিছু টাকা আয়ের সুযোগও থাকে। তাই তাদের অনেকেই ওজন মাপার মেশিন নিয়ে সুবিধাজনক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েন সহজ উপার্জনের আশায়।
ওজন মেশিন নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষগুলোর গল্প প্রায় একই রকম। ছয় থেকে সাত জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এদের কেউই এই কাজকে একমাত্র পেশা হিসেবে নেননি। বরং নিজেদের স্থায়ী কাজ বা চাকরির পাশাপাশি তারা এই কাজ করেন।
বিকেল হলে তাদের কর্ম থেকে ছুটি মেলে, এরপর মেশিন নিয়ে বসে পড়েন পার্ক বা রাস্তার এক কোণায়। এর জন্য আলাদা করে কোনো চাঁদা দিতে হয় না। যেকোনো একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে যান। তবে স্থান হিসেবে বেছে নেন জনবহুল এলাকা।
বয়স্ক ব্যক্তিদের পছন্দের পেশা
পার্কে তাদের আনাগোনা বেশি। পার্কে দৈনিক শত শত মানুষের আসা-যাওয়া থাকে। যদি দিনে ৫০-১০০ জন মানুষও ওজন মাপে, তবে তাদের আয় ৫০০ থেকে ১০০০ টাকায় পৌঁছায়। সাধারণ চোখে এই আয় অল্প মনে হলেও, তাদের জীবনে এই টাকা অনেক গুরুত্ব বহন করে।
শারীরিক পরিশ্রম না থাকায় বয়স্ক মানুষরা এই পেশায় বেশি আগ্রহী। একটি চেয়ার বা টুল নিয়ে বসে থাকেন, আর যখন যাকে ইচ্ছে হয়, ওজন মেপে নেন। অসুবিধা বলতে হঠাৎ রোদের তীব্রতা বা জোরে বৃষ্টি নামা। রোদের মধ্যে কাজ চালিয়ে নেওয়া গেলেও বৃষ্টিতে কাজ বন্ধ রাখতে হয়।
এই মানুষগুলোর জীবন ক্লান্তিহীন পথিকের মতো। এক কাজ সেরে আবার অন্য কাজে মনোনিবেশ করেন। রাত ৯-১০টা পর্যন্ত এভাবেই সময় কাটে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আনাগোনা কমে গেলে তারা বাড়ি ফেরেন। আবার পরের দিন একই রুটিনে কাজ চলে।
আব্দুর রহমানের কথাই ধরা যাক। বয়স চল্লিশের আশেপাশে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের লেকের পাশে নিয়মিত মেশিন নিয়ে বসেন। প্রায় ২৪ বছর ধরে তিনি এই কাজ করছেন। এর আগে ছোটখাটো ব্যবসা করতেন, কিন্তু ক্ষতির মুখে পড়ে সেটি ছেড়ে দিয়ে এই কাজে নামেন। বর্তমানে এর পাশাপাশি তিনি অন্য কাজও করেন, তবে ঠিক কী করেন, তা নিয়ে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেন না বলার।
কিছু মেশিন ব্যাটারির, কিছু চলে চার্জে
২০০১ সাল থেকেই এই পেশায় আছেন আব্দুর রহমান। তার আয়ের পরিমাণও অন্যদের তুলনায় বেশ ভালো। জানালেন, দিনে ১৫০০-২৫০০ টাকা পর্যন্ত আয় করেন তিনি। এত বেশি টাকা শুনে কিছুটা অবাক লাগলো বটে।
জানালেন, তার মেশিন অন্যদের মতো সাধারণ নয়। তার এক মেজর মামা জাপান থেকে নিয়ে এসেছেন সেটি। মেশিনটির দাম এক লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি। এই এক মেশিনে ওজন, উচ্চতা, রক্তচাপ, হার্টবিট মাপা যায় এবং করা যায় শক্তি পরীক্ষাও।
ব্যাটারির সাহায্যে চলে এটি। একবার চার্জ দিলে সপ্তাহখানেক আরাম করে চালিয়ে নেওয়া যায়। সবচেয়ে ভালো দিক হলো, মাপার পর যেকোনো তথ্যের জন্য একটি ছোট্ট রিসিটও পান ব্যবহারকারীরা।
মেশিনগুলো বেশিরভাগ সময় তারা কেনেন নওয়াবপুর থেকে। কেউ কেউ আবার চকবাজার বা গুলিস্তান থেকে কেনার কথা জানিয়েছেন। কিছু মেশিনে চার্জ দিতে হয়। ২০-৪০ মিনিটের চার্জ দিলে তা তিন দিন অনায়াসে চলে।
অন্যদিকে, ডিজিটাল মেশিনগুলো হয় ব্যাটারিচালিত। একটি পরিবারে এ মেশিন কেনা হলে এক ব্যাটারি দিয়ে মাসখানেক চলে। ১০-১৫ হাজার টাকার ভেতর লোহার মেশিনগুলোতে ২৪০ কেজি পর্যন্ত ওজন মাপা যায়, আর ডিজিটাল মেশিনগুলোতে সর্বোচ্চ ১০০ কেজি পর্যন্ত।
এই মেশিনগুলোর দাম ভিন্ন ভিন্ন হয়, যেমন ৭০০, ৮০০, ১০০০, ১২০০ বা ১৫০০ টাকা। ডিজিটাল মেশিনের দাম কম হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষ এগুলোই প্রাধান্য দেন।
মো. সিদ্দিক হোসেন বলেন, ‘লোহার মেশিনটা ভালো বেশি। সহজে নষ্ট হয় না। কিন্তু অইটা কিনতে মেলা টাকা লাগে। এইজন্য আমি ডিজিটালটাই কিনসি। এইটার অসুবিধা হলো মাঝেমধ্যে ভাইঙ্গা যায়। কিন্তু দাম কম হওয়াতে পরে আরেকটা কিনা যায়।’
সংখ্যায় কম হলেও, কেউ কেউ এই কাজকেই একমাত্র পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। মো. তুহিনের মতোই কয়েকজন আছেন যারা প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি ওজন মাপার কাজ করেন।
তুহিন থাকেন লালবাগের শহীদনগরে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি সাইন্সল্যাব মোড়ে দাঁড়িয়ে ওজন মাপার কাজ করেন। বিগত তিন বছর ধরে তিনি এই কাজ করে আসছেন। মোড়ের ফুটওভার ব্রিজে ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন, যারা ব্রিজ দিয়ে রাস্তা পার হন, তাদের অনেকেই কৌতূহলবশত নিজের ওজন মেপে নেন।
তুহিনের পরিবারে তার দুই ভাই এবং তিন বোন আছেন। তার ভাই-বোনেরা কেউ গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করেন, কেউবা খাবারের হোটেলে। তুহিন এসব পেশায় আগ্রহ না থাকায় বেছে নিয়েছেন ওজন মাপার কাজ। দিনে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা আয় করেই তিনি সন্তুষ্ট।
‘বেকার থাকার চেয়ে এই অল্প টাকাই ভালো। নিজের খরচ মেটাতে পারছি, আবার পরিবারকেও কিছুটা সাহায্য করতে পারছি,’ বলেন তিনি।