ধর্ম

‘উমরাহ সফরের গল্প’

ভাবনার রঙতুলিতে আমি আঁকি বালুকাময় মরুভূমির একটুকরো দৃশ্য। একপাশে কয়েকটা খেজুর গাছ এবং কিছু লতাগুল্ম। খেজুর গাছের তলায় একটা তাঁবু অথবা ভগ্নপ্রায় কুঁড়েঘর। সেই কুঁড়েঘরের বাইরে গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করছেন একজন মহিলা—নাম তার আতিকা। ইতিহাসে তিনি সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন উম্মে মা’বাদ নামে।

কাজের ফাঁকে তার চোখ হঠাৎ আটকে যায় দূরের দিগন্তে। তিনি দেখতে পান দুটো ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। সময়ের সাথে সাথে স্পষ্ট হয়ে উঠছে তাদের অবয়ব-রেখা। একসময় সেই দুই ছায়ামূর্তি তার দুয়ারে এসে দাঁড়াল। উম্মে মা’বাদ দেখলেন শুভ্র বসনের দুজন অতি সুদর্শন পুরুষ তার উঠোনে দাঁড়িয়ে। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা ভীষণ তৃষ্ণার্ত। তাদের সারা শরীরে পথের অনিঃশেষ ক্লান্তি। পথিকদ্বয়ের একজন হলেন আল্লাহর রাসুল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, অন্যজন তাঁর হিজরতের সঙ্গী আবু বাকার রাদিয়াল্লাহু আনহু। মক্কার কুরাইশদের ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করে তারা উভয়ে দেশান্তরী হয়েছেন। তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য হলো—মদিনা।

কখনো রুক্ষ পাহাড়, কখনো পাথুরে পথ, কখনোবা ধূলিঝড়—সমস্ত ঝড়ঝাপ্টা পাড়ি দিতে দিতে উভয়ে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। সাথে বয়ে আনা খাবার আর পানীয়—কোনোটাই অবশিষ্ট নেই। অবস্থা এত সকরুণ যে শরীর চলতে চায় না। একটু খাবার, একটু পানি ভীষণ দরকারি।

উম্মে মা’বাদের উঠোনে দাঁড়িয়ে নবিজি জিগ্যেস করলেন, ‘আপনার কাছে খাদ্য জাতীয় কিছু পাওয়া যাবে যা আমরা কিনতে পারব?’

কিন্তু তাকদিরের কী লিখন, উম্মে মা’বাদের সংসারেও তখন দুর্ভিক্ষ হানা দিয়েছে। খরার কারণে মাঠের সমস্ত ঘাস, লতা-পাতা মরে গেছে। তাদের বকরিগুলো ভালো খেতে পায় না অনেকদিন। শুকিয়ে সেগুলো কাঠ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। একটা কিছু যে পথিকদ্বয়কে সাধবেন—ঘরে এমন কোনোকিছুই খুঁজে পেলেন না উম্মে মা’বাদ।

উম্মে মা’বাদের নিশ্চুপতা দেখে খানিক বাদে আবার কথা বললেন নবিজি। পাশেই বাঁধা ছিল একটা রুগ্ন বকরি। হাড় জিরজিরে সেই বকরিকে দেখলে যে-কারোই মায়া হবে। সেই বকরির দিকে তাকিয়ে নবিজি বললেন, ‘এই বকরি কি দুধ দেয়?’

এবার কথা বললেন উম্মে মা’বাদ। তিনি বললেন, ‘না, এটা দুধ দেয় না। দুর্বলতার কারণে এটা অন্য বকরির সাথে চরতে যেতে পারে না। এখানেই বাঁধা থাকে।’

নবিজি আবার বললেন, ‘যদি অনুমতি দেন, আমি এই বকরির দুধ দোহন করতে চাই।’

নবিজির কথা শুনে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে পড়েন উম্মে মা’বাদ! বলে কী এই আগন্তুক! এক কদম হাঁটবার জোর পায় না যে বকরি, সেই বকরি থেকে দুধ দোহন করতে চাচ্ছেন তিনি! বড় আশ্চর্য, বড় বিচিত্র! তবে বিস্ময়ের ভাব নিজের মাঝে গোপন রেখে উম্মে মা’বাদ বললেন, ‘আপনি চাইলে দোহন করতে পারেন।’

অনুমতি লাভের পর আল্লাহর রাসুল ‘বিসমিল্লাহ’ বলে বকরির ওলানে হাত দিলেন এবং সাথে সাথে ঘটে গেল এক আশ্চর্য ঘটনা। দুর্বলতার কারণে নড়াচড়া পর্যন্ত যার বন্ধ প্রায়, সেই বকরি নবিজির হাতের স্পর্শ পেয়ে কেমন তরতাজা পশুর মতো গা ঝাড়া দিয়ে উঠল! আরও আশ্চর্য ব্যাপার—তার ওলান যেন দুধের ভারে নুইয়ে পড়ছে!

নবিজি একটা বড় পাত্র আনতে বললে উম্মে মা’বাদ দ্রুত তা নিয়ে আসেন এবং নবিজির হাতে দেন। দুধ দোহন করতে গিয়ে দেখা গেল, এত অবিশ্রান্ত ধারায় বকরির ওলান থেকে দুধ বেরিয়ে আসছে যে—যেন এটা এক নিঃসীম ঝরনাধারা, যেন এই দুধের জোয়ারে আর কোনোদিন ভাটা আসবে না। এমন অলৌকিক ঘটনা দেখে বিস্ময়ে চোখের পাতা স্থির হয়ে যায় উম্মে মা’বাদের! মেঘহীন নীল আকাশ থেকে অঝোর ধারার বৃষ্টি নেমে আসার মতোই এই ঘটনা—অবিশ্বাস্য!

পথের ভারে ক্লান্ত এবং তৃষ্ণার্ত তারা, তবু চোখের সামনে এমন পেয়ালা ভর্তি দুধ পাওয়ার পরেও নবিজি নিজে খেলেন না। উম্মে মা’বাদকে বললেন যেন তিনি সবার আগে পান করেন। বিস্ময়াবিভূত উম্মে মা’বাদ এক নিঃশ্বাসে অনেকখানি দুধ পান করে ফেললেন। এত সুস্বাদু বকরির দুধ আগে কখনো খেয়েছেন বলে তার মনে পড়ে না। উম্মে মা’বাদ তৃপ্তি সহকারে দুধ পান শেষ করলে, আল্লাহর রাসুল ঘরের অন্যদের পান করিয়ে আনতে বললেন। ঘরের সকলেও খেলো—অত্যন্ত তৃপ্তির সাথে। সকলের শেষে খেলেন নবিজি এবং আবু বাকার।

উম্মে মা’বাদ যথেষ্টই বুদ্ধিমতি ছিলেন। সম্মুখে দাঁড়ানো আগন্তুককে চিনে ফেলতে তার একটুও ভুল হলো না। নিতান্ত সাধারণ বেশভূষায় আল্লাহর প্রেরিত দূত যে তার উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছেন আজ—তা বুঝতে পারার সাথে সাথে তিনি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের ওপর ঈমান আনয়ন করলেন। কোথাও বৃষ্টি নেই, চারদিকে খরা আর দুর্ভিক্ষ চলছে, কিন্তু উল্টো ঘটনা উম্মে মা’বাদের হৃদয়ে। সেখানে তৈরি হয়েছে ঈমানের ফেনিল সমুদ্র।

আল্লাহর রাসুল আর আবু বাকার বিদায় নিলেন, কিন্তু যে মোহনীয় আবেশ উঠোনজুড়ে রেখে গেলেন তা কাটিয়ে উঠা উম্মে মা’বাদের পক্ষে অসম্ভব। সেই ঘোর লাগা দৃশ্যগুলো যেন এখনো জীবন্ত, এখনো দৃশ্যমান।
পেয়ালায় তখনও অনেকখানি দুধ অবশিষ্ট রয়ে গেছে। এরই মাঝে মাঠে চরতে যাওয়া বকরিদের তাড়া করতে করতে ঘরে ফিরলেন উম্মে মা’বাদের স্বামী আবু মা’বাদ। ঘরে এসে পেয়ালাভর্তি দুধ দেখে তিনি আশ্চর্য হয়ে যান!

দুধ দেওয়ার মতো কোনো বকরি তো তাদের কাছে নেই। আর, এই বিরান মরুভূমির জনমানবশূন্য প্রান্তরে কে এসে ঘরে দিয়ে যাবে পেয়ালাভর্তি দুধ? স্ত্রীর কাছে জানতে চান সমস্ত ঘটনা। আবেশে অভিভূত উম্মে মা’বাদ সমস্তটা খুলে বলেন রাখাল স্বামীকে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েন আবু মা’বাদও। আজকে যেন তাদের বিস্মিত হবার দিন। আশ্চর্যান্বিত আবু মা’বাদ স্ত্রীকে বললেন, ‘বলো তো, সেই আগন্তুক দেখতে কেমন ছিল?’

সেই মিলিয়ে আসা বিকেলে আল্লাহর রাসুল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে শারীরিক বর্ণনাটা উম্মে মা’বাদ স্বামীর কাছে দিয়েছিলেন, ইতিহাসের পাতায় পাতায় তা স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করা আছে। নবিজি সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সবচেয়ে সুন্দর, পরিপূর্ণ আর পরিশীলিত দৈহিক বর্ণনাটা এসেছে একজন বেদুইন নারীর কাছ থেকে—ইতিহাসে এটা অত্যন্ত বিরল একটা ঘটনা!

এত চমৎকারভাবে নবিজির বর্ণনা দিয়েছিলেন উম্মে মা’বাদ, শুনলে মনে হয় যেন তিনি কোনো চিত্রশিল্পী, প্রস্তুত ছিলেন রঙতুলি হাতে। নবিজির আগমনের সাথে সাথে যেন তিনি এঁকে ফেললেন তাঁর নিখুঁত, নিখাদ অবয়ব।

‘নবিজি দেখতে কেমন ছিলেন’ তা উম্মে মা’বাদ এভাবে বলেছেন—‘তাঁর চেহারা উজ্জ্বল গৌরবর্ণ। সুন্দর গড়ন, সটান দেহ। চিত্তহারি তাঁর চরিত্র, লাবণ্যময় মুখ। তিনি অতিশয় দীর্ঘও নন, খাটোও নন। তাঁর ডাগর কালো চোখ, যেন তাতে সুরমা মাখানো। দীঘল চোখের পাতা ও ঘন কালো পাপড়ি। সরু তাঁর ভ্রু যুগল। ঋজু তাঁর কণ্ঠস্বর। যখন কথা বলেন, মনে হয় যেন মুক্তো ঝরছে। তাঁর প্রকাশভঙ্গি স্পষ্ট এবং গাম্ভীর্যতায় ভরা।’

বালুকাময় মরুভূমি প্রান্তরে যে শুভ্র, পবিত্র চেহারার মানুষটির বর্ণনা উম্মে মা’বাদ সেদিন দিয়েছিলেন, সেই পবিত্র মানুষটি এই সবুজ গম্বুজের নিচে শায়িত আছেন। যার হাতের স্পর্শে শীর্ণকায় বকরির ওলানে নেমেছিল দুধের প্লাবন, সেই মুবারক হাতের মানুষটির খুব কাছাকাছি আমি দাঁড়িয়ে। এই আবেশের কোনো দাম হয় না। দুনিয়ার সকল সম্পদ জড়ো করেও কেনা যাবে না এই অনুভূতি। তবু, আসমানের রব আমাকে এনে দাঁড় করিয়েছেন এই পবিত্র নগরীর নববি উঠোনে। ইয়া রব, আপনার দরবারে আমার নতমস্তক কৃতজ্ঞতা।
.

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button