হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা ও মিমেটিক তত্ত্ব

হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার ঘটনাটি জনপ্রিয় একটি জার্মান গল্প। জার্মানির লোয়ার স্যাক্সনি প্রদেশের ওয়েসার নদীর তীরে অবস্থিত হ্যামিলন শহর। বর্তমানের হ্যামেলিন শহরে যদি আপনি কখনো বেড়াতে যান. তবে দেখবেন সেখানে রাস্তার মোড়ে বাঁশিওয়ালার একটি মূর্তি আছে, সাথে ইঁদুর। মূলত বাঁশিওয়ালার গল্পটি নিছক ছেলেধরার কাহিনী, এর সাথে শুধু হ্যামিলন জায়গাটা যোগ হয়েছে।অনেকটা আমাদের বনলতা সেনের সাথে যেভাবে নাটোর যুক্ত হয়েছে। প্রতি বছর ২৬ জুন পালন করা হয় র্যাট ক্যাচার দিবস। যে রাস্তায় সর্বশেষ বাঁশিওয়ালাকে দেখা গিয়েছিল বলে দাবী করা হয়, সে রাস্তার নাম হচ্ছে Bungelosen strasseবা ‘নো ড্রাম স্ট্রিট’। এ রাস্তায় কোনো মিউজিক বাজানো নিষিদ্ধ। প্রায় ৭০০ বছর ধরেই এমনটি চলে আসছে বলে জানা যায়। ১২৮৪ এর দিকে জার্মানে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। ইঁদুর ছিল এ রোগের বাহক। সে সময় শহরে ইঁদুর ধরার বিশেষ লোক ছিল, যারা বাঁশি বাজিয় ইঁদুর ধরতো। সেসময় প্লেগে অনেক শিশু মারা যায়। তাই পুথির পাতায় বর্নিত বাঁশিওয়ালাকে আসলে রূপক অর্থে তুলে ধরা হয়েছে।
এবার চলুন রেনে জিরার্দের মিমেটিক তত্ত্ব সম্পর্কে জানি, কারো হাতে দামী স্মার্টফোন বা দামী হাতঘড়ি, দামী পোশাক, বা দামী মোটরসাইকেল দেখে এইসব নিজের পেতে বা ক্রয় করতে ইচ্ছে করে। কারো কাছে এই সবগুলো দেখে অন্য ব্যক্তির মনে কেনার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। কোনো একটি রেস্তোরাঁতে বসে পাশের টেবিলে কাউকে কিছু খেতে দেখে নিজের জন্যও সেই একইরকম খাবার অর্ডার করা। মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দেখে,কোনো পণ্য বা মডেলকে বারবার দেখে, সে পণ্য বা মডেলের মতো কিছু বা কাউকে দেখলে প্রেমে পড়ে যাওয়া ।
দুটি শিশু একসঙ্গে অনেক খেলনা নিয়ে খেলার সময় যেকোনো একটি খেলনার দখলকে কেন্দ্র করে নিজেদের মাঝে মারামারিতে জড়িয়ে যেতে পারে। কেননা প্রথম শিশুর হাতে সেই বিশেষ খেলনা দেখে অন্য শিশুটি বাকি খেলনাগুলোকে ভুলে গিয়ে প্রথম শিশুর হাত থেকে তা কেড়ে নিতে উদ্যত হতে পারে। এই সবই মিমেটিক ডেজায়ারের সহজ বহিঃপ্রকাশ।
ফরাসি দার্শনিক রেনে জিরার্দের বলেন যে, “মানুষের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা আসলে স্বতন্ত্র নয়, বরং আমরা অন্যদের অনুকরণ করেই আমাদের ইচ্ছা গঠন করি।” মানুষ শুধুমাত্র অন্যের থেকে কথা, আচরণ বা পোশাক-আশাক বা বস্তু কেন্দ্রিক বিষয়গুলো অনুকরণ করে না বরং সে অন্যের থেকে তার ‘Desires (ইচ্ছা/বাসনা/আকাঙ্খা)’ -ও অনুকরণ করে থাকে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ‘সৃজনশীলতায়’। সব মানুষ যদি অন্যের অনুকরণ করতেই থাকে; তাহলে মানুষ নিজেকে এবং নিজের ক্ষমতাকে ছোট করে প্রতিনিয়ত। সবাই যদি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার পিছনে ছুটে নদীতে ঝাঁপ দেয় তাহলে সমাজ সভ্যতার আলো নিভে যাবে; কাউকে না কাউকে তার নিজস্ব ও ভিন্নতার মশাল নিয়ে সামনে এগুতে হবে।