ট্রেনের মালিক এক কৃষক

তিনি মুকেশ আম্বানি কিংবা রতন টাটার মত নামকরা কোন শিল্পপতি নন। একজন সামান্য কৃষক। কিন্তু কৃষক হয়েও হয়েছেন ট্রেনের মালিক। বিষয়টি কারও কাছে শুনতে আজগুবি লাগতে পারে। অনেকে খেলনা ট্রেন ভেবে উড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্তু সত্যি সত্যি ভারতের এক কৃষক আস্ত ট্রেনের অধিকারী। আর তাঁর ট্রেনের মালিক হবার পেছনেও রয়েছে দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের গল্প।
আসলে রেলের এক ভুলেই ভারতের সম্পূরণ সিং নামের এক কৃষক একটা আস্ত ট্রেনের মালিকানা লাভ করেন। আর এখানেই শেষ নয়, বাড়িতে বসে রীতিমতো ট্রেনের আয়ের অংশও পেয়ে যান তিনি। সম্পূরণ সিং পাঞ্জাবের লুধিয়ানার কাতানা গ্রামের বাসিন্দা।
২০০৭ সালে লুধিয়ানা-চণ্ডীগড় রুটে রেললাইন নির্মাণের সময় রেলওয়ে কৃষকদের জমি কিনছিল। একর প্রতি ২৫ লাখ টাকা দরে ক্ষতিপূরণ দিয়ে সম্পূরণের জমি অধিগ্রহণ করে ভারতীয় রেল। সেই সময় সম্পূরণ সিংয়ের জমিও কিনেছিল রেল কর্তৃপক্ষ।
সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু কিছুদিন পরই সম্পূরণ সিং জানতে পারেন, তাদের গ্রামেই তার জমির সমান পরিমাণ আরেকটি জমি রেলওয়ে অধিগ্রহণ করেছে প্রতি একর ৭১ লাখ টাকা হিসেবে। অর্থাৎ দুটি জমি দুই রকমের দরে কিনেছে ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষ।
আর তাঁকে দেওয়া হয়েছিল মাত্র ৪২ লক্ষ টাকা। রেলের থেকে সম্পূরণ জমি বিক্রি বাবদ ১.০৫ কোটি টাকা দাবি করেন। দাবিকৃত টাকা হাতে না পেয়ে ২০১২ সাল নাগাদ আদালতে ক্ষতিপূরণের দাবিতে মামলা ঠুকে দেন।
প্রথমবার সেই মামলায় জয় হয় সম্পূরণের। আদালত নির্দেশ দিলেও রেলের কাছ থেকে এক পয়সাও ক্ষতিপূরণ পাননি তিনি। বাধ্য হয়ে ফের কোর্টে যান। তারপরেই আসে এই চমকে দেওয়া রায়। ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিচারপতি যশপাল ভার্মা একটি এক্সপ্রেস ট্রেন সম্পূরণকে দিয়ে দেন। বিচারক যশপাল বর্মার নির্দেশে ১২০৩০ নম্বর স্বর্ণ শতাব্দী এক্সপ্রেসকে ক্ষতিপূরণের সম্পত্তি হিসেবে অ্যাটাচ করে নেওয়া হয়। অর্থাৎ সম্পূরণ সিংহই কার্যত ট্রেনটির মালিক বনে যান।
মামলায় জিতে পাওয়া এই স্বর্ণ শতাব্দী এক্সপ্রেস ট্রেনটি অমৃতসর এবং নতুন দিল্লির মধ্যে চলাচল করে। এক্সেপ্রেস ট্রেনের পাশাপাশি, ট্রেনটির যেখান দিয়ে যাওয়ার কথা, সেই লুধিয়ানা স্টেশনের স্টেশন মাস্টারের অফিসের দখলও সম্পূরণ সিংকে দিয়ে দেওয়া হয়। আর আদালতের এই রায় শুনে ভারতীয় নাগরিকদের চক্ষু চড়ক গাছ হওয়ার জোগাড় হয়ে যায়।
২০১৭ সালেই ২০ কোচ ট্রেনের মালিকানা পান সম্পূরণ। তবে ট্রেন পেয়ে সেটি দিয়ে কি করবেন তা নিয়ে বেশ ধন্দে পড়ে যান তিনি। কারণ এটা তো আর হাতি কিংবা ঘোড়া নয় যে, বাড়িতে বয়ে আনবেন। এতকিছুর মাঝেও যেদিন কোর্টের রায় তাঁর হাতে এসেছিল, তিনি আইনজীবীর সঙ্গে লুধিয়ানা স্টেশনে গিয়েছিলেন। সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন আদালতে প্রতিনিধিরাও।
সম্পূরণ সিংহকে মালিকানা দেওয়ার নির্দেশনামা সাঁটিয়ে দেওয়া হয় স্টেশন মাস্টারের অফিস কক্ষেও। আদেশনামা ট্রেনের চালকের হাতে তুলে দেওয়া হয়। রেলের এক বিভাগীয় ইঞ্জিনিয়ার আনুষ্ঠানিকভাবে আদালতের প্রতিনিধির হাতে ট্রেনটিকে তুলে দেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গোটা পর্বটা সেরে ফেলা হয়৷
কিন্তু ট্রেনটাকে বেশিক্ষণ থামানো হয়নি। না হলে বহু যাত্রীকে অসুবিধায় পড়তে হতো। স্টেশনে ঢোকার পরে ট্রেনটিকে আবার গন্তব্যে রওনা করিয়ে দেওয়া হয়। অত সংখ্যক যাত্রীদের সমস্যা হোক, সেটা কৃষক সম্পূরণ কখনওই চাননি।
এইভাবে ভারতের ইতিহাসে সম্পূরণ সিং-ই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি একটি যাত্রীবাহী ট্রেনের মালিক হয়ে গিয়েছিলেন। তবে কিছুদিন পর আদালতে গিয়ে ট্রেনটিকে খালাস করিয়ে নিয়েছিলেন ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা।
বিষয়টি এখনো আদালতে বিচারাধীন বলে জানা গেছে। বিচারের রায় পাওয়ার পর জানা যাবে, ‘অমৃতসর স্বর্ণ শতাব্দী এক্সপ্রেস’-এর প্রকৃত মালিক কে, কৃষক সম্পূরণ সিং নাকি ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষ!