গ্রীষ্মে লোডশেডিং হতে পারে ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট

আসন্ন গ্রীষ্ম মৌসুমে ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, ‘রমজান মাস যাতে লোডশেডিংমুক্ত রাখা যায় আমরা সেই চেষ্টা করব। তার অর্থ এই নয় যে লোডশেডিং হবে না। এটা নানা কারণে হতে পারে। কখনো বিতরণ লাইন আবার কখনো সঞ্চালন ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে লোডশেডিং হতে পারে। আমরা ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করব।’
অর্থ সংকটের কারণে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘অর্থ সংকট থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। আমাদের ওপর অনেক চাপ থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুতের দাম বাড়াইনি। ব্যয় সংকোচন করে সমন্বয় করছি। তবে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির যে প্রস্তাব তাতে বর্তমান গ্রাহকদের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ গ্যাস আমদানিতে খরচ পড়ে ৭২ টাকা, আমরা বিক্রি করি ৩০ টাকায়। এ ঘাটতি সমন্বয়ের জন্য নতুন করে যারা গ্যাস সংযোগ নেবেন তাদের ক্ষেত্রে দাম কিছুটা বাড়তে পারে।’
বিদ্যুৎ উপদেষ্টা বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখন দৈনিক ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেয়া হচ্ছে। রমজান মাসে তা বাড়িয়ে ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত করা হবে। এরপর এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। এজন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত জ্বালানি আমদানি করা হবে। রমজানের জন্য প্রাক্কলনের বাইরে অতিরিক্ত আরো চার কার্গো এলএনজি আমদানি করা হবে।’
দেশে লোডশেডিং হওয়ার প্রধান কারণ মূলত প্রাথমিক জ্বালানি সংকট। এ প্রাথমিক জ্বালানি সংস্থানের জন্য অর্থ সংকট রয়েছে। এরই মধ্যে অর্থসংস্থানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। রমজান গ্রীষ্ম ও সেচের মৌসুমে যে অর্থের প্রয়োজন, সেই প্রতিশ্রুতি অর্থ বিভাগ থেকে দেয়া হয়েছে বলে ব্রিফিংয়ে জানান উপদেষ্টা। এছাড়া অর্থ ও ডলার নিয়ে যাতে জটিলতা না হয়, সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে মন্ত্রণালয়।
লোডশেডিংয়ের কারণ সম্পর্কে বিদ্যুৎ উপদেষ্টা বলেন, ‘আর্থিক কারণে নয়, অপচয়ের কারণে লোডশেডিং হচ্ছে। কুলিং লোডের (এসির লোড) কারণে লোডশেডিং গ্রীষ্মে বেশি হয়। গ্রীষ্মে কুলিং লোডের কারণে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের বেশি চাহিদা তৈরি হয়। আমরা যদি এসির তাপমাত্রা ২৫-২৬ রেখে চালাই, তাহলে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে টেলিভিশনগুলোয় বিজ্ঞাপন প্রচার করা হবে। লোডশেডিং যাতে না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট সব বিভাগকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এবার লোডশেডিং হলে কোনো বৈষম্য হবে না। লোডশেডিং হলে গ্রামে নয়, আগে ঢাকায় লোডশেডিং করা হবে।’
বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বকেয়া নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ সরবরাহ যাতে বন্ধ করতে না হয় সেজন্য তাদের বকেয়াও পরিশোধ করা হবে। তবে সম্পূর্ণ হয়তো করা যাবে না।’
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দুটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেসব কমিটির প্রতিবেদন পাওয়া গেছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘বড় সাতটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি পর্যালোচনায় যে কমিটি কাজ করছে, তাদের আইনি সহায়তা প্রয়োজন। সেটি নিয়ে কাজ চলছে। আমরা মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের বেঞ্চমার্ক করেছি। প্রতি ইউনিটের দাম ধরা হয়েছে ৮ টাকা ৪০ পয়সা। এখন এ বেঞ্চমার্ক ধরে অন্যান্য কেন্দ্রের সঙ্গে করা চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করা হবে।’
রমজান ও গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে আগামী জুনের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ৪ বিলিয়ন ডলার চেয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ। এর মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগ ৩ বিলিয়ন ডলার এবং বাকি অর্থ জ্বালানি আমদানি, অর্থাৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ফার্নেস অয়েল ও গ্যাস আমদানির জন্য। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ দেয়ার অনুরোধ জোনানো হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে এ অর্থ চাওয়া হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুতের অনাদায়ী বিল নিষ্পত্তি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা আমদানি সহজতর করতে অর্থ বিভাগ থেকে ২৮ হাজার কোটি টাকা (২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার) ছাড় করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের মোট ভর্তুকি প্রয়োজন ৫৯ হাজার কোটি টাকা (৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার)। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণে সহায়তার জন্য সরকার এখন পর্যন্ত ৩৪ হাজার কোটি টাকা পেয়েছে।
রমজান শুরু হতে বাকি এক মাসেরও কম। এ সময় সেচ মৌসুমের ফলে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। জ্বালানি আমদানির অনিশ্চয়তা ও বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বকেয়া পরিশোধে বিলম্বের কারণে আসন্ন রমজান ও গ্রীষ্মকালে সারা দেশে ব্যাপক লোডশেডিংয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি আমদানি ও বকেয়া চেয়ে এরই মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক করেছে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকেরা।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, দুই বছর ধরে তারা বিদ্যুৎ কেন্দ্র মালিকদের পাওনা পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ২০২২ সাল থেকে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন শুরু হওয়ায় এ সংকট দেখা দেয়।
বিদ্যুৎ ভবনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জ্বালানি সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসানসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের কর্মকর্তারা।