মতামত

সংস্কার, ম্যান্ডেট ও নির্বাচন নিয়ে একের ভেতর দুই ফর্মুলা

ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেড়শত দিন পার হয়েছে৷ অভ্যুত্থান-পরবর্তী নানা ধরনের ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল। কমিশনগুলো তাদের প্রস্তাব সরকারের কাছে শীঘ্রই পেশ করবে। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি কমিশন প্রধান পত্রপত্রিকায় সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে প্রস্তাবিত সংস্কার সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন।

এ প্রেক্ষাপটে অন্তত দুটি ব্যাপার বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। প্রথমত সংস্কার প্রস্তাবসমূহ রাষ্ট্রের গণতন্ত্রীকরণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম কি না। কথাটির আরেক তাৎপর্য এই, আদৌ এমন প্রস্তাব করা হয়েছে কি না যা বিদ্যমান রাষ্ট্র ও সংবিধানের এককেন্দ্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোয় লাগাম টানতে সক্ষম হবে। এ প্রসঙ্গে চূড়ান্ত মন্তব্য করার জন্য কমিশনগুলোর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনগুলোর অপেক্ষায় থাকতে হবে। দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি আরও জরুরি। প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করবে কারা এবং কোন পদ্ধতিতে? বিশেষত সংবিধান সংস্কার কোন প্রক্রিয়ায় হবে তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র জাতীয় ঐকমত্য নয়; সঠিক পদ্ধতির গুরুত্বও অস্বীকার করা যাবে না।

সংস্কার বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য অনিবার্য। এ লক্ষ্যে সরকার কমিশনগুলোর প্রধানদের নিয়ে জাতীয় ঐক্য কাউন্সিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ যথাক্রমে এই কাউন্সিলের সভাপতি ও সহ-সভাপতির ভূমিকা পালন করবেন। তবে কার্যকর ঐক্য হাসিলের লক্ষ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি, বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করাও জরুরি।

পদ্ধতির প্রশ্নে সবচেয়ে বড় তর্কটি সংবিধান সংস্কার কোন প্রক্রিয়ায় কারা করবে, সেই প্রশ্নকে ঘিরে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সংবিধান সংস্কারের ম্যান্ডেট আছে কি না বিএনপি ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকবার এমন প্রশ্ন তুলেছে। তাদের দাবি সংবিধান সংস্কার করতে হবে নির্বাচিত সংসদে। এ প্রসঙ্গে আমরা পরে আবার ফিরব। এ পর্যায়ে সংবিধান সংশোধনী এবং সংস্কার কিংবা নতুন সংবিধান প্রণয়নের তফাত সম্পর্কে আলোচনা সেরে নেয়া যাক।

সংশোধনী ও সংস্কারের ধারণাকে অনেক ক্ষেত্রে অদল-বদল করে ব্যবহারের নজির পাওয়া যাচ্ছে। ধারণাগত ও পদ্ধতিগতভাবে কিন্তু সংশোধনী ও সংস্কার অভিন্ন নয়৷ সংশোধনী সংবিধানের তেমন কোনো মৌলিক পরিবর্তন নয়। বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে ওই সংবিধানেরই সামান্য কিছু সংযোজন-বিয়োজন সংশোধনীর লক্ষ্য। মূলত সংবিধানের কোনো ধারা বা অনুচ্ছেদ অধিকতর স্পষ্টকরণের স্বার্থে সংশোধনীর উদ্যোগ নেয়া হয়। সংবিধানের ক্ষমতা কাঠামোর ব্যাপক ও মৌলিক পরিবর্তন এর উদ্দেশ্য নয়। দুই-তৃতীয়াংশ সংসদীয় আসনের সমর্থন থাকলেই এ কাজ করা যায়। আবার পরবর্তী সংসদ কিংবা বিচার বিভাগ চাইলে আনীত সংশোধনী বাতিল করে দিতে পারে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনার একাধিক নজির রয়েছে। আপাতত এ পর্যায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন (১৯৯৬ সাল), বাতিল (২০১১ সাল) এবং পুনঃপ্রবর্তনের (২০২৪ সাল) নজির টানা যেতে পারে। অর্থাৎ, সংশোধনী দীর্ঘস্থায়ী নয় এবং ত্রুটিযুক্ত সংশোধনী পরবর্তীতে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সংস্কার কথাটির অর্থ দাঁড়িয়েছে একব্যক্তিকেন্দ্রীক ও স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোর মৌলিক পরিবর্তন তথা গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক কাঠামো। এর জন্য প্রয়োজন জনগণের বিপুল অংশগ্রহণ ও মতামত। বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে সংসদ গঠন করে এ কাজ করার কোনো সুযোগ নাই। অর্থাৎ, সংবিধান সংস্কার কিংবা পরিবর্তনের এখতিয়ার সংসদের কাছে থাকে না। কারণ সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন স্থায়ী ও দুষ্পরিবর্তনীয়। বিচার বিভাগ কিংবা পরবর্তী সংসদ চাইলেই দুই-তৃতীয়াংশের জোরে গৃহীত সংস্কারকে বাতিল করে দিতে পারে না; বরং, প্রণীত অথবা সংস্কারকৃত সংবিধানই আদালতের বিচারের ভিত্তি।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সংবিধানের স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোর পরিবর্তনের দাবি অন্তত এক যুগ পুরোনো। অভ্যুত্থানের পর হঠাৎ করে এ দাবি হাজির হয় নাই। গণতান্ত্রিক সংবিধান আন্দোলন, রাষ্ট্রচিন্তাসহ বেশ কয়েকটি বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্যোগ বিদ্যমান সংবিধানের স্বৈরতান্ত্রিকতা এবং এর সমাধানের লক্ষ্যে সংবিধান সংস্কারের অনিবার্যতার কথা বেশ আগে থেকেই প্রচার করে আসছিল। মূলত এ সকল সংগঠনের সংবিধান বিশ্লেষণের পথ ধরেই রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, গণতন্ত্র মঞ্চের মতো রাজনৈতিক সংগঠন ও জোটের আবির্ভাব ঘটে যারা সংস্কারকে রাজনৈতিক এজেন্ডায় পরিণত করে। আরও পরে এসব মিত্র সংগঠনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিএনপিও কিছু কিছু সংস্কারে সম্মত হয়। বিএনপির ৩১ দফাকে এ সকল উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় বুঝতে হবে।

সংবিধানকে বলা হয় জনগণের সামষ্টিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের লিখিত দলিল। সংসদ জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা আইন প্রণয়নী সভা। জনগণের প্রতিনিধিগণ জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় বদলে দিতে পারে না। তাদের কাজ হচ্ছে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় মোতাবেক আইন প্রণয়ন করা। যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় বদলে গেছে কিংবা বিদ্যমান সংবিধান জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে চলে গেছে, সেক্ষেত্রে জনগণ নতুন করে তার ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের লিখিত রূপ দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এ কারণে সংবিধানের প্রস্তাবনায় “আমরা বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের জন্য এই সংবিধানটি গ্রহণ করিলাম” ধরনের বাক্যের উপস্থিতি দেখা যায়। কিছু বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি মিলে একটি সংবিধান লিখে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেবে, ব্যাপারটা অত সরল নয়। সাধারণত গণঅভ্যুত্থানের মতো বড় ঘটনার পর এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। এ কারণে আইন ও দর্শনশাস্ত্রে গণঅভ্যুত্থানকে ‘গাঠনিক মুহূর্ত’ বলা হয়ে থাকে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে সংবিধান সংস্কার কিংবা নতুন সংবিধান প্রণয়ন জনগণ কোন প্রক্রিয়া করে থাকে তথা সংবিধান গ্রহণ করার ম্যান্ডেট কোথায় থাকে? বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে গঠিত সংসদের কাছে এমন ম্যান্ডেট থাকে না,
এ কথা আগে একবার উল্লেখ করা হয়েছে৷ সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামোর মৌলিক পরিবর্তন আনতে হলে গণপরিষদ তথা সংবিধান সভার (Constituent Assembly) নির্বাচন আহ্বান করতে হয়। উক্ত নির্বাচনে বিজয়ীরা গণপরিষদ বিতর্কের মাধ্যমে একটি সংবিধান প্রস্তুত করে। প্রয়োজনে গণভোটের দ্বারস্থ হতে হয়।

অর্থাৎ সংবিধান প্রণয়নের জন্যও একটি নির্বাচনের প্রয়োজন হয়। একে গণপরিষদ নির্বাচন বলা হয়। আশ্চর্যজনকভাবে এমন নির্বাচনের যে অতীত নজির রয়েছে, বর্তমান বাস্তবতায় এটি যে অনিবার্য, রাজনৈতিক দলগুলো তা স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়।

বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় আসন্ন নির্বাচন হওয়া উচিত গণপরিষদ নির্বাচন। বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে সংসদ নির্বাচনে যাওয়া হবে সহস্রাধিক শহিদ ও অর্ধলক্ষ আহতদের সাথে চরম বেঈমানি। নির্বাচিত গণপরিষদ গণআকাঙ্খার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি সংবিধান দেশবাসীকে উপহার দেবে। তবে গণপরিষদে নির্বাচিতদের দ্বারা প্রণীত সংবিধানে যে গণআকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটবেই ঘটবে, এর নিশ্চয়তা কী? এমন প্রশ্ন ন্যায্য ও যৌক্তিক। তাই গণপরিষদের সামনে একটি লিগ্যাল ফ্রেমঅর্ডার (এলএফও) নির্ধারণ করে দিতে হবে। কেউ কেউ একে বলছেন “সংস্কার ফ্রেমওয়ার্ক”। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত এলএফও মূলত গণপরিষদের চরিত্র ও অভিমুখ ঠিক করে দেবে। বহুদলীয় গণতন্ত্র, পাচারবিরোধী উদারনৈতিক অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক বহুত্ব, ধর্মীয় সহাবস্থান ও অসাম্প্রদায়িকতাসহ নূন্যতম ঔচিত্য নির্ধারণই হবে এলএফও প্রণয়নের লক্ষ্য। নির্বাচিত গণপরিষদ কর্তৃক এলএফও লঙ্ঘনের ঘটনা প্রতিবিপ্লব হিসেবে সাব্যস্ত হবে। তেমন পরিস্থিতিতে রাস্তায় নেমে গণআন্দোলন ও অনানুগত্য সম্পূর্ণ ন্যায্য বলে বিবেচিত হবে।

গণপরিষদের মাধ্যমে প্রণীত নতুন সংবিধানের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়াই প্রচলিত রেওয়াজ। তবে এক্ষেত্রে দুটি নির্বাচনী ধাপ (প্রথমটি গণপরিষদ) পার হতে হয়। ক্ষমতায় যেতে উদগ্রীব রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এ প্রক্রিয়া দীর্ঘ মনে হতে পারে। সেক্ষেত্রে আসন্ন নির্বাচন একইসাথে গণপরিষদ ও আইনসভার নির্বাচন হতে পারে। নির্বাচিতরা প্রথমে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (১২০ দিন হতে পারে) জাতিকে একটি সংবিধান উপহার দেবে, তারপর ওই গণপরিষদই আইনসভায় রূপ নেবে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব হবে গণপরিষদ বিতর্কের ভিত্তি দলিল। সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক কমিটির সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবে এই একের ভেতর দুই ফর্মুলা লক্ষ করা গেছে।

সংস্কার অনিবার্য। ম্যান্ডেটের প্রশ্ন অনেকক্ষেত্রে মিসপ্লেসড। গণঅভ্যুত্থান গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ মূর্ত রূপ। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকারের কাছে ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ ভোট পেয়ে নির্বাচিত সরকারের চেয়ে অনেক বেশি ম্যান্ডেট থাকে। জনপ্রশাসন, পুলিশ, শিক্ষা, নির্বাচন, দুদকসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের আশু সংস্কারের ম্যান্ডেট অন্তর্বর্তী সরকারের রয়েছে। তবে সংবিধান প্রণয়ন/সংস্কারের জন্য গণপরিষদ গঠন করাই যুক্তিযুক্ত। বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে গঠিত সংসদ সংবিধান সংস্কার/প্রণয়ন করবে, এমন চিন্তা বিভ্রান্তিমূলক।

সারোয়ার তুষার, যুগ্ম আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক কমিটি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button