জাতীয়

গাইবান্ধার কর্মী সম্মেলনে আমীরে জামায়াত

শহীদদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে হলে দখলদারিত্ব চাঁদাবাজি বন্ধ করতেই হবে

দখলবাজ এবং চাঁদাবাজমুক্ত দেশ গড়তে নেতাকর্মীদের ত্যাগ স্বীকার করার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা শফিকুর রহমান বলেছেন, সকল ক্ষেত্রে বৈষম্যহীন দেশ গড়তে চাই; যে দেশে দখলবাজি, চাঁদাবাজি চলবে না। দুর্বলেরা সবল দ্বারা অত্যাচারিত হবে না। শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা পাবে। সমতা-সাম্য কায়েম হবে দেশে। জুলাই আন্দোলনে শহীদরা যে দেশ চেয়েছিলেন তার বাস্তব নমুনা দেখাতে চাই।

২৪ ডিসেম্বর মঙ্গলবার গাইবান্ধা ইসলামিয়া উচ্চবিদ্যালয় মাঠে ঐতিহাসিক কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। কর্মী সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ মাওলানা মমতাজ উদ্দিন ও অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলাল, সাবেক জেলা আমীর ডা. আবদুর রহীম সরকার ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজিবুর রহমান পলাশ। মঞ্চের পাশেই ছিলেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা।

সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও গাইবান্ধা জেলা আমীর মো. আব্দুল করিম সরকার। জেলা সেক্রেটারি মাওলানা জহুরুল হক সরকারের সঞ্চালনায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ফয়সাল কবীর রানা, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কের পক্ষে মুহিদ আহমেদ ফাহিম, গাইবান্ধা জেলা জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমীর বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ওয়ারেছ, জেলা নায়েবে আমীর অধ্যাপক মাজেদুর রহমান, মাওলানা নজরুল ইসলাম লেবু, জামায়াত নেতা নুরুন্নবী প্রধান, জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি সৈয়দ রুকুনুজ্জামান, ফয়সাল কবির রানা, শহর শাখার আমীর অধ্যাপক একেএম ফেরদৌস আলম, সদর উপজেলা আমীর মাওলানা নূরুল ইসলাম মন্ডল, পলাশবাড়ী উপজেলা আমীর আবু বকর সিদ্দিক, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা আমীর আবুল হোসেন মাস্টার, সাদুল্লাপুর উপজেলার আমীর এরশাদুল হক ইমন, ফুলছড়ি উপজেলার আমীর মাওলানা সিরাজুল ইসলাম, সাঘাটা উপজেলার আামীর মাওলানা ইব্রাহীম হোসাইন ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার আমীর অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম মঞ্জু প্রমুখ। বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে হামদ, নাত ও ইসলামী সংগীত পরিবেশন করা হয়।

পাালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার অত্যাচারের বর্ণনা দিয়ে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, গত ১৫টা বছর সারাদেশে ছিলো ছোপ-ছাপ রক্ত। গাইবান্ধা ছিল লাশ আর ছোপ-ছাপ রক্তের জনপদ। কত মা কত বোন কত সন্তানের বুক যে খালি হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। বহু মানুষ ধরে নিয়ে গুম করা হয়েছে। তার সঠিক সংখ্যা আল্লাহপাক কেবল জানেন।

আয়না ঘর সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা দিয়ে বলেন, আয়না ঘরের মানুষগুলোকে নিয়ে আমার পাশের সেলে রাখা হতো। আয়না ঘরে থাকা মানুষগুলো আমাকে বলেছেন, বহু বছর ধরে তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে, অন্ধকার ঘরে রাখা হয়েছে। কিন্তু তা স্বীকার করা হয়নি। এদের কাউকে কাউকে নাটকের ফাঁদে ফেলে হত্যা করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ আগেই জানান দিয়েছিল যে, ক্ষমতায় গিয়ে তারা কী করবে। কিন্তু সেটা জনগণ বুঝতে পারেনি। রাজধানীর পল্টন ময়দানে ৬ জন মানুষকে খুন করে প্রকাশ্য দিবালোকে। লাশের উপর দাঁড়িয়ে তারা নাচানাচি করেছে। সারা দুনিয়া এ ঘটনার ধিক্কার জানিয়েছে। এরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে যেভাবে দুর্নীতিতে ডুবে গেছে; জনগণ আর তাদের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না।

এরপর পিলখানায় ৫৭ জন দেশপ্রেমিক চৌকশ সেনা অফিসার হত্যা করে বিডিআর ও সেনাবাহিনীর মনোবল ধ্বংস করে দেয়। দুটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হলেও এই হত্যাকা-ের রিপোর্ট আজও প্রকাশ করা হয়নি। পরের বছর জামায়াতকে ধরলো। কেন বেছে নিলো জামায়াতে ইসলামীকে? কারণ জামায়াতের লোকজনও প্রকৃত দেশপ্রেমিক। তারা কখনো দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয় না। এজন্য জামায়াতের প্রতি তাদের এতো ক্ষোভ। এই ক্ষোভে তারা জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ অনেক নেতাকর্মীকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেয়।

এরপর আরেক দেশপ্রেমিক শক্তি হেফাজতে ইসলামকে বেছে নিলো। এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সম্মানের পাত্র তারা। ২০১৩ সালের ৫ মে আমরা জেল থেকে দেখেছি। তাদের কত মানুষ হত্যা করেছে তা আল্লাহ পাক জানেন। লাশগুলো কোথায় নিয়ে ফেলা হয়েছে কেউ জানে না।

তিনি সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের নাম উল্লেখ করে বলেন, এই মানুষটা হুমকি দিয়েছিল ছাত্রদের এই বলে যে, বাড়াবাড়ি করলে শাপলা চত্বরের ভাগ্যবরণ করতে হবে। এই লোকটা আত্মস্বীকৃত খুনী।

আমীরে জামায়াত রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের নাম উল্লেখ করে বলেন, আপানাদের পাশের জেলায় বুকপেতে বলেছিল, ‘বুকের ভিতর তুমুল ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’। আবু সাঈদরা বলেছিল উই ওয়ান্ট জাস্টিস। আমরা একটা বৈষম্যহীন সমাজ চাই। আমরা একটি মানবিক সমাজ চাই। আমরা একটা গর্বের বাংলাদেশ চাই।

এই বাংলাদেশ গড়া হবে শহীদদের রক্তের প্রতি সম্মান দেখিয়ে। এই দেশ গঠন করতে হলে দখলদারিত্ব বন্ধ করতে হবে। চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার চলবে না। অফিস আদালত কোর্ট কাচারি থেকে ঘুষ দুর্নীতি নির্মূল করতেই হবে।

তিনি বৈষম্যহীন দেশ গড়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় এলে শহীদরা যে উদ্দেশ্য নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে সেই দেশের বাস্তব নমুনা দেখানো হবে। দেশ হবে চাঁদাবাজ-দখলবাজহীন। সেখানে সন্ত্রাস থাকবে না। শ্রমিকরা তার অধিকার বুঝে পাবে। সমতা আর সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে।

গাইবান্ধায় কোন উচ্চ শিক্ষার কেন্দ্র নাই উল্লেখ করে ডাক্তার শফিকুর রহমান বলেন, এই এলাকার মানুষ ইসলামপ্রিয় বলেই বৈষম্য করা হয়েছে। তিনি বর্তমান সরকারের কাছে গাইবান্ধায় কৃষি বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জানান। তিনি এও জানিয়ে দেন জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় এলে জেলাবাসীকে কোন কিছু দাবি করে আদায় করতে হবে না। স্বাভাবিকভাবেই হয়ে যাবে।

হাসপাতাল এবং বিচারালয়ে গিয়ে মানুষ বিচার পাচ্ছে না উল্লেখ করে ডা. শফিকুর রহমান আরও বলেন, এই দেশে মেজরিটি আর মাইনোরিটি বলে কিছু থাকবে না। এসময় তিনি স্বাধীনতার পর থেকে সংখ্যা লঘুদের ওপর যত হামলা হয়েছে এবং এসব হামলার পেছনে কারা জড়িত তাদের খুাঁজে বের করে এসব ঘটনা নিয়ে শে^তপত্র প্রকাশ করার দাবি জানান। তিনি বলেন, মহিলারা তার প্রাপ্য সম্মান পাবে সবক্ষেত্রে। সবখানে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। রাছুল (সা.) যুদ্ধের ময়দানেও কাজে লাগিয়েছেন নারীকে।

তিনি জামায়াতের নেতাকর্মীদের দখলবাজ চাঁদাবাজদের প্রশ্রয় না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন আমাদের নিজেদের মান উন্নয়ন করতে হবে।

মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, এই দেশে স্বৈরাচারের কবর হবে। আওয়ামী লীগের বিচার আগে হবে। কোন কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের পক্ষে কথা বলেন। এটা খুবই দুঃখজনক। অত্যাচারের শিকার হয়েও জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা দ্বীন বিজয়ের জন্য কাজ করছেন এবং আন্দোলন করেছেন উল্লেখ করে মাওলানা হালিম আরও বলেন, আমাদের প্রত্যেক কর্মীকে দেশ রক্ষার দায়িত্ব পালনে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। আমরা একটি দুর্নীতিমুক্ত দখলদার মুক্ত দেশ গড়ে তুলতে চাই। এজন্য জামায়াতে ইসলামীর প্রতিটি কর্মীকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে।

মাওলানা মমতাজ উদ্দিন বলেন, জাতি তাকিয়ে আছে জামায়াতে ইসলামীর দিকে। অতীতের শাসকদের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তাই জামায়াতের কর্মীদের রাষ্ট্র পরিচালনার গুণ অর্জন করতে হবে। ইসলামী জ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে হবে।

অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলাল বলেন, খুনি হাসিনাকে ভারত থেকে এনে বিচার করা হবে। নইলে আবারো খুনি সৃষ্টি হবে। সৎ শাসন কায়েম করতে হবে। এজন্য আগামী নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীকে জয়ী করতে হবে।

ডা. আবদুর রহীম সরকার বলেন, ইসলামের প্রতি জনসমর্থনের দিক থেকে গাইবান্ধা উর্বর। ৯ জন শহীদের রক্তাক্ত জেলা গাইবান্ধা। ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে ইসলাম বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য জাতীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। একবিংশ শতাব্দীতে ইসলামের বিজয় হবে। সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে।

রাজিবুর রহমান পলাশ বলেন, ফ্যাসীবাদ পুনর্বাসনের ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দেওয়া হবে। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে চাইলে তাদের বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করা হবে।

সাবেক ছাত্র নেতা মাওলানা শাফিউল ইসলামের অর্থসহ কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে কর্মী সম্মেলন শুরু হয়। কর্মী সম্মেলনের উদ্বোধন করেন পলাশবাড়ী উপজেলার জুলাই বিপ্লবে শহীদ আরিফুল ইসলামের বড় ভাই রাশিদুল ইসলাম। তিনি আওয়ামী লীগ এবং তাদের প্রশ্রয়দানকারীদের গ্রেফতার ও বিচার দাবি করেন। শহীদ আরিফুল ইসলামের হত্যার বিচার দাবি করেন। সম্মেলনে ইসলামী সঙ্গীত পরিবেশন করেন জেলা নবোচ্ছ্বাস শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্যরা।

সভাপতির বক্তব্যে আব্দুল করিম সরকার বলেন, নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে। জামায়াতে ইসলামী এ ব্যাপারে অঙ্গিকারবদ্ধ।

যা বললেন হিন্দু পুরোহিত
পলাশবাড়ী মন্দিরের পুরোহিত শ্রী মিলন কুমার ভট্ট্রাচার্য্য ঠাকুর এসেছিলেন কর্মী সম্মেলনে শুভেচ্ছা বক্তব্য দিতে। তিনি জানালেন, তার বড়ভাই ছিল জামায়াতের সমর্থক। এখন তিনি নিজেও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন করেন। ইসকন সদস্যরা হিন্দুদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে জানিয়ে এই পুরোহিত বলেন, পূজা পার্বনে এরা বিভেদ সৃষ্টিকারী। আওয়ামী লীগের লোকজন নেই এখন; ফলে তাদের কোন নিরাপত্তা সংকটও নেই। এবারের পূজাতে তাদের পুলিশ প্রয়োজন হয়নি বলেও জানান মিলন ভট্টাচার্য্য।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button