প্রকাশের তারিখ : ০৫ অক্টোবর ২০২৫
পরিশ্রম আর প্রতিভার মিলনে বুটেক্স শিক্ষার্থীরা গড়ছে টেক্সটাইল খাতের ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশের অর্থনীতি যেন একটি বিশাল জাহাজ, আর সেই জাহাজের ইঞ্জিন রুমের প্রধান প্রকৌশলী হলেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স)-এর শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক (rmg) খাত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধারাবাহিক সাফল্য অর্জন করে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক হিসেবে অবস্থান শক্ত করেছে। গ্রীন ফ্যাক্টরি, টেকসই উৎপাদন ও উচ্চমানের পোশাক সরবরাহে দেশের অগ্রগতির পেছনে মুখ্য অবদান রাখছে এবং বুটেক্স শিক্ষার্থীরা প্রতিভা ও পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে টেক্সটাইল খাতকে নিয়ে যাচ্ছে বিশ্বমঞ্চে।একটি গবেষণায় দেখা যায়, টেক্সটাইল, পাট এবং তৈরি পোশাক (rmg) খাত বাংলাদেশের বৃহত্তম শিল্পখাত এবং দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি এই খাত থেকে আসে। বুটেক্স গ্র্যাজুয়েটরা এই শিল্পের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে, যা জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে।ইয়ার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে, এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা সরাসরি সুতা উৎপাদনের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির দায়িত্ব পালন করেন। তারা ফাইবার নির্বাচন, স্পিনিং প্রক্রিয়া আধুনিকীকরণ, এবং পরিবেশবান্ধব সুতা (যেমন রিসাইকেলড বা অর্গানিক) উৎপাদনে নেতৃত্ব দেন। আন্তর্জাতিক মানের পোশাক তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সেরা মানের কাঁচামাল নিশ্চিত করা এবং দেশের স্পিনিং শিল্পের আমদানি নির্ভরতা কমানোই তাদের প্রধান ভূমিকা।ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে, এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা পোশাকের মূল কাঠামো অর্থাৎ কাপড় তৈরির কৌশল এবং নতুন ধরনের কাপড় উদ্ভাবনে অগ্রণী। তারা বুনন (weaving) ও নিটিং (knitting) প্রক্রিয়াকে নিখুঁত ও দ্রুত করার মাধ্যমে উৎপাদন দক্ষতা বাড়ান।অ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে, এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা পোশাক তৈরির প্রক্রিয়াকে দ্রুত ও ত্রুটিমুক্ত করতে লিন ম্যানুফ্যাকচারিং কৌশল প্রয়োগ করেন। তারা কারখানার উৎপাদনশীলতা ও গুণগত মান নিশ্চিত করে দ্রুত পরিবর্তিত বৈশ্বিক ফ্যাশন ট্রেন্ডের সঙ্গে মিল রেখে পণ্য বাজারে আনছেন।ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে, এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা ডাইং ও ফিনিশিং প্রক্রিয়াকে পরিবেশবান্ধব করতে কাজ করেন। তারা জল-সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার করে বর্জ্য ও দূষণ কমানোর মাধ্যমে কারখানাগুলোকে 'জিরো ডিসচার্জ' লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।ডাইজ অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে, এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা পরিবেশসম্মত রং (eco-friendly dyes) ও রাসায়নিকের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করছেন। তারা রাসায়নিক আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে টেক্সটাইল পণ্যের নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব বাড়াচ্ছেন।টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে, তারা প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা (management skills) সমন্বয় করে কারখানার কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন।ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে, তারা উৎপাদন খরচ ও সময় সাশ্রয়ের মাধ্যমে শিল্পকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলে।টেক্সটাইল মেশিনারি ডিজাইন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে, উৎপাদন বন্ধ থাকার সময় কমানো। পাশাপাশি, দেশীয় প্রযুক্তিতে অটোমেশন এবং নতুন যন্ত্রাংশ তৈরি করে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির খরচ কমানো তাদের প্রধান লক্ষ্য।টেক্সটাইল ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে, ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার করে ফাইবারকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যযুক্ত (যেমন: জীবাণুরোধী) করছেন। তারা মেডিকেল টেক্সটাইল ও স্মার্ট পোশাকের মতো উচ্চ-মূল্যের পণ্যের ভিত্তি তৈরি করছেন।এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে, তারা পরিবেশগত নীতি ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (যেমন etp) নিশ্চিত করেন। তাদের গবেষণা বাংলাদেশের কারখানাগুলোকে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের চাহিদামাফিক গ্রিন ফ্যাক্টরি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করছে।টেক্সটাইল ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের মতে, তারা ফ্যাশন ট্রেন্ড বিশ্লেষণ করে সৃজনশীল ডিজাইন তৈরি করেন। এর ফলে বাংলাদেশ কেবল বেসিক পণ্য নয়, উচ্চ-মূল্যের ও ফ্যাশনেবল পণ্য রপ্তানি করতে সক্ষম হচ্ছে।টেক্সটাইল ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের মতে, তারা ফ্যাশন ট্রেন্ড বিশ্লেষণ করে সৃজনশীল ডিজাইন তৈরি করেন। এর ফলে বাংলাদেশ কেবল বেসিক পণ্য নয়, উচ্চ-মূল্যের ও ফ্যাশনেবল পণ্য রপ্তানি করতে সক্ষম হচ্ছেসম্প্রতি, ৪৭তম ব্যাচের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চারজন শিক্ষার্থী যারা কচুরিপানা ও রিসাইকেল জিন্স ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব জুতা তৈরি করেছেন। এই উদ্ভাবনের মাধ্যমে তারা পরিবেশ সংরক্ষণে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যেখানে কচুরিপানা দিয়ে জুতার ইনসোল ও বাইরের সোল তৈরি করা হয়। এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হলো পরিবেশ দূষণ কমানো এবং প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করে টেকসই পণ্য তৈরি করা।পরবর্তীতে তাদের এই উদ্ভাবনীটি সারা বাংলাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলো।সবশেষে, বুটেক্সের এই শিক্ষার্থীরাই তাদের মেধা, শ্রম এবং উদ্ভাবনী মানসিকতা দিয়ে বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাতকে শুধু টিকিয়ে রাখছেন না, বরং বিশ্বমানের টেকসই শিল্পে রূপান্তর করছেন। তাদের হাত ধরেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিজয়যাত্রা অপ্রতিরোধ্য।
কপিরাইট © ২০২৫ ধ্রুবকন্ঠ । সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত