নোয়াখালী সরকারি কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ ও ফেনীর ফুলগাজি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর লোকমান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে নোয়াখালী সরকারি কলেজে থাকাকালীন পাহাড়সম দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও আওয়ামী নেতাদের পদলেহনের অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষা ক্যাডারে আওয়ামী সমর্থক প্যানেলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক'ও ছিলেন তিনি। এছাড়াও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণে ৫ আগষ্ট পরবর্তী অনেকদিন তিনি কলেজে না এসে গা ডাকা দিয়েছিলেন। সবশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে তাকে নোয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে অপসারণ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে ওএসডি করে সংযুক্ত করে মন্ত্রণালয়।
প্রফেসর লোকমান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম, সহকর্মীদের হেনস্তা এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তদন্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের শৃঙ্খলা শাখা থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। এবং দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক থেকে আলাদা আরেকটি তদন্ত কমিটি করা হয়। নোয়াখালী কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সচেতন মহলের প্রত্যাশা ছিলো তদন্ত কমিটির নিরপেক্ষ তদন্তের ভিত্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তদন্ত কমিটির তদন্তে অসংখ্য অভিযোগ প্রমানিত হওয়ার পরে নিয়ম মোতাবেক তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হওয়ার বিধান আছে। কিন্তু সকলকে অবাক করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা না করে তদন্তে প্রমাণিত গুরুতর অভিযোগ বাদ দিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অভিযোগ রেখে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। বিভাগীয় মামলা না করে লোকমান ভূঁইয়াকে সাধারণ কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার নেপথ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শাহীনা পারভীন বলে শোনা যাচ্ছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের কারণে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাকে ০৩ আগস্ট স্ট্যান্ড রিলিজ করে বদলি করেন। তার বদলির আদেশ বহাল থাকলেও শাহীনা পারভীন কেনো এই চেয়ার ছাড়তে নারাজ সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে লোকমান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা না করেই তার বিরুদ্ধে প্রমাণিত বিষয়কে প্রমান হয়নি বলে মিথ্যাচার করা হয়েছে। কিন্তু আইনজ্ঞদের থেকে জানা যায়, প্রশাসনিক তদন্তে অভিযোগ প্রমানিত হলে তার বিরুদ্ধে ডিপি হবে এবং তাকে অভিযোগনামা, অভিযোগ বিবরণীসহ কারণ দর্শানোর নোটিশ হবে। নোটিশের জবাবের পর শুনানি গ্রহণ এবং পরবর্তী তদন্ত করে দ্বিতীয় কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করে জবাব নিয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার প্রক্রিয়া আছে। অসংখ্য প্রমানিত অভিযোগ কারণ দর্শানোর নোটিশে উল্লেখ না করে গোজামিল দিয়ে লোকমান ভূঁইয়ার পক্ষে অবস্থান নেন শাহীনা পারভীন। ০৩ আগস্ট থেকে তার বদলি হলেও ০৭ আগষ্ট অর্থাৎ তিনি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েও খালাসের পত্র স্বাক্ষর করে চলেছেন। তার বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ না করে এবং তদন্ত প্রতিবেদনে প্রকাশ না হওয়ার আগেই গত দু তিন মাস আগে মাউশিতে ওএসডি থাকা প্রফেসর লোকমান ভূঁইয়াকে ফেনীর ফুলগাজি কলেজের অধ্যক্ষ পদে পদায়ন করে মন্ত্রণালয়। ফ্যাসিবাদের দোসর লোকমান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে অধ্যক্ষ পদে পদোন্নতি দেওয়ার রেশ কাটতে না কাটতেই গত ০৭ আগষ্ট মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের শৃঙ্খলা শাখা থেকে ৩৭.০০.০০০০.০৯৫.৯৯.০৭.২৫ স্বারক থেকে উপসচিব শাহানা পারভিনের সাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রফেসর লোকমান ভূঁইয়াকে নির্দোষ দাবি করে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ থেকে তাকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়।
এর পরপরই বিষয়টির রহস্য উদঘাটনে অনুসন্ধানে নামে নোয়াখালী সরকারি কলেজ সাংবাদিক সমিতির সদস্যরা। অনুসন্ধানে নামতেই এ যেন কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে এলো । জানা যায়, কারাগারে থাকা জুলাই গণহত্যার আসামি ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দিপু মনির আস্থাভাজন ছিলেন লোকমান ভূঁইয়া। এবং দিপু মনি সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা রতন কুমার মজুমদারকে ম্যানেজ করে উপাধ্যক্ষের পদ বাগিয়ে নেন তিনি। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিতর্কিত ও আওয়ামী মদদপুষ্ট সদ্য বরখাস্তকৃত সচিব ছিদ্দিক জোবায়েরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এই লোকমান ভূঁইয়া এবং শোনা যাচ্ছে উপসচিব জনাব শাহানা পারভিন ও নাকি তার আত্মীয় হয়৷ লোকমান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের সত্যতা খুঁজতে মাউশির পরিচালক বরাবর পাঠানো তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সংগ্রহ করে এই প্রতিবেদক। সেখানে দেখা যায়, নোয়াখালী সরকারি কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সাবেক প্রভাষক জনাব আব্দুর রাজ্জাকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির সভাপতি ও সেনবাগ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর এ.কে.এম সেলিম চৌধুরী সাক্ষরিত সে/স/৩৪/২০২৫ স্মারকে গত ১১/০৩/২০২৫ তারিখে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নিকট তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। উক্ত তদন্ত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায় লোকমান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পাবলিক পরীক্ষার হলে প্রবেশ ও বহিরাগতদের প্রবেশে সহায়তা, কলেজের কক্ষ ব্যাবহার করে গরু পালন, অনুমতি ব্যাতীত কলেজের গাছ কর্তন ও বিক্রয়, কলেজের পুকুর ভূমি নাম মাত্র মূল্যে জনৈক আওয়ামী লীগ নেতার কাছে ইজারা প্রদানে সহায়তা, সহকর্মীদের সাথে দুর্ব্যবহার, কলেজ ক্যাম্পাসে বিনা ভাড়ায় বসবাস, নিজের ব্যবহারের সুবিধার্থে কলেজের সীমানাপ্রচীর ভাঙন, অভিযোগকারীর সাথে আপত্তিকর আচরণ ও গায়ে থাপ্পড় মারার অভিযোগ সত্য প্রমাণ করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। তদন্তে আরো দেখা যায়, তিনি ফেসবুকে লেখেন "জিতবে আবার নৌকা, শেখ হাসিনার বিকল্প নাই"!
লোকমান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটির সভাপতির নিকট প্রদান করা উক্ত প্রতিবেদনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের জবানবন্দি ও অভিযোগ প্রমানের পক্ষে সাক্ষীর সাক্ষ্য ও পর্যালোচনা করেছে প্রতিবেদক। উক্ত জবানবন্দি ও সাক্ষ্য গুলোতে দেখা যায় অভিযোগের সত্যতা প্রমাণে তারা পর্যাপ্ত তথ্য ও যুক্তি উপস্থাপন করেন৷
এছাড়াও নোয়াখালী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর সালমা আক্তারের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ । ২০২৩-২৪ অর্থবছর ও পরবর্তী অর্থবছরের ১২/১১/২০২৪ পর্যন্ত মোট ১৬ মাস ১২ দিনে কলেজের খেলাধুলা তহবিল, উন্নয়ন তহবিল, বিজ্ঞান তহবিল, ম্যাগাজিন ও রেডক্রিসেন্ট সহ মোট ২২ খাতে ৫,০৩,০৬,৯৭৫,০০ (পাঁচ কোটি তিন লক্ষ ছয় হাজার নয়শত পঁচাত্তর টাকা) ব্যায় করেন। অভিযোগ রয়েছে অধ্যক্ষ প্রফেসর সালমা আক্তার ও উপাধ্যক্ষ লোকমান ভূঁইয়ার যোগসাজশে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে উক্ত ব্যায়ের কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে।
নোয়াখালী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আকরাম উদ্দিন বলেন, লোকমান ভূঁইয়া স্যার রাজনৈতিক নেতাদের মতো আচরণ করতেন। আমরা শুনেছি তিনি দুর্নীতি ও অনিয়ম করে কলেজের অনেক ক্ষতি করেছেন। কলেজের আসন্ন অডিটে যাতে উনার এবং সাবেক অধ্যক্ষ সালমা ম্যাডামের দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়া যায় সেজন্য হয়তো লবিং করে আবারো নোয়াখালী কলেজে আসার চেষ্টা করছেন। তবে আমরা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই দুর্নীতিতে অভিযুক্ত এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিরোধিতা করা কাউকে অধ্যক্ষ হিসেবে শিক্ষার্থীরা মেনে নিবে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শাহানা পারভিন বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে আমি তো মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র না। যতটুকু জানি উনাকে (লোকমান ভূঁইয়া) কি কি অন্যায় করেছেন সে বিষয়ে শোকজ করা হয়েছে। পরবর্তীতে শোকজের জবাবের ভিত্তিতে সিনিয়র স্যাররা যে রায় দিয়েছেন, আমি শুধু সেটা সাক্ষর করেছি। তদন্ত কমিটির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আসলে আমার এত কথা তো মনে নাই, যেকোনো একজনের বিষয়ে তো এত কথা মনে থাকে না। আপনারা যদি মন্ত্রণালয়ে এসে জানতে চান, দেখতে চান তাহলে দেখতে পারেন।
কিন্তু, প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, শাহীনা পারভীনকে অভিযোগের ভিত্তিতে স্ট্যান্ড রিলিজ করলেও তিনি চেয়ার ছাড়তে নারাজ এবং লোকমান ভূঁইয়ার নিকট থেকে ঘুষের বিনিময়ে সিনিয়রদের নিকট মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করে ভুল বুঝিয়ে ফাইল স্বাক্ষর করে নিয়ে বিপুল আয় করে চলেছেন। এই শাহীনা পারভীন এই ডেস্কে থাকলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোন অভিযোগের সুষ্ঠু বিচার সম্ভব নয় বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এবং কীভাবে লোকমান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে ডিপি না করে খালাস করা হলো এই নথি বিষয় তদন্ত হওয়া দরকার বলে নোয়াখালী সরকারি কলেজ শিক্ষার্থীরা দাবী জানিয়েছেন।
সম্পাদক: মোঃ ফয়সাল | প্রকাশক: এইচ এম শাহ পরান | বিভাগীয় প্রধান (অনলাইন): ইমরান হোসেন