সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সারা দেশ উত্তাল ছিল। এই আন্দোলনকে দমাতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরকার তাদের পেটুয়া বাহিনী ছাত্রলীগ, যুবলীগের পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করে। এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়ে নিহত হয়েছেন অনেক শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। শেষপর্যন্ত শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের তোপের মুখে সেই বছরের আগস্টের ৫ তারিখ দুপুরে দেশ থেকে পালিয়ে যান ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা।
‘রাজাকার’ শব্দটি বর্তমানে বাংলাদেশে একটি বিতর্কিত শব্দ এবং এটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। মূলত, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা দেশের বিপক্ষে অর্থাৎ পাকিস্তানের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিল, তাদের রাজাকার বলা হতো। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে ছাত্রজনতার কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাজাকার শব্দটি প্রতিবাদী স্লোগান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কেননা দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের আন্দোলনে বন্ধ হওয়া কোটা প্রথা ২০২৪ সালের জুনে আবারও পুনর্বহাল করলে আন্দোলনে নামে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এরপর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ সম্বোধন করলে তীব্র ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে ছাত্রসমাজ।
অনেকে মনে করেন , সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা, যিনি তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে বহুবার ‘রাজাকার’ শব্দটি ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে নানাভাবে ট্যাগ দিয়েছেন, আঘাত করেছেন, আজ ইতিহাসের সেই শব্দেই যেন আঘাতপ্রাপ্ত স্বয়ং, তার বিদায়ের ঘণ্টাও বাজে এই শব্দ থেকেই।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
২০২৪ সালের ১৪ জুলাই (রবিবার) বিকেল চারটায় চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিকে – সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকেই টানা আন্দোলনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন ছাত্রজনতা।
আন্দোলনকে আমলে না নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর নানা বল প্রয়োগ করার অভিযোগ ওঠে সরকারের বিরুদ্ধে। সেদিনের সংবাদ সম্মেলনে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে তাদের এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না তো কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে? এটি দেশবাসীর কাছে আমার প্রশ্ন।’
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর দেশজুড়ে সৃষ্টি হয় কড়া সমালোচনা। ওই দিন মধ্যরাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিভিন্ন হল থেকে মিছিল বের করতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর টুকরো টুকরো মিছিল নিয়ে সবাই জড়ো হন টিএসসিতে। এসময় শিক্ষার্থীরা ‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার’ কে বলেছে, কে বলেছে; সরকার সরকার এসব বলে স্লোগান দিতে থাকেন। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও তাদের হল থেকে মিছিল নিয়ে বের হতে শুরু করেন।
এদিন রাত সোয়া ১১টার দিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ মিছিল করবো। সবাই বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে বের হচ্ছে। আমরা সবাই একসঙ্গে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করব। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হল ও জসীম উদ্দীন হল শাখা ছাত্রলীগের দুজন পদধারী নিজ নিজ পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন ফেসবুকে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্র ধরেই তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান।
ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে একইদিন দিনের বেলায় আন্দোলনকারীরা বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির বরাবর স্মারকলিপি দেন। এতে সংসদের অধিবেশন ডেকে কোটা সংস্কারের দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে সরকারকে চব্বিশ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন আন্দোলনকারীরা। রাজধানী ছাড়াও দেশের কয়েকটি জেলায় শিক্ষার্থীরা গণপদযাত্রা
কর্মসূচি পালন করেন। মিছিল নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় জেলা প্রশাসকের (ডিসি) মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেন তারা। একইসঙ্গে বিক্ষোভ সমাবেশ করে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশের হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। ১৩ জুলাই সারা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ এবং ৬৪ জেলায় একযোগে অনলাইন ও অফলাইনে প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। একই দিন সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা হয়। একই দিন দাবি আদায়ে আন্দোলন পরিচালনার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রতি ১০ নির্দেশনা দেয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। জুলাইয়ের ঘটনায় ১৩ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে পুলিশের যানবাহন ভাঙচুর, হামলা এবং মারধরের অভিযোগ তোলে শাহবাগ থানায় মামলা করে পুলিশ।