চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. কুশলবরণ চক্রবর্তী ভারতের উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা যোগী আদিত্যনাথকে ‘আধ্যাত্মিক নেতা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে শুরু হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক। শিক্ষার্থী, মানবাধিকারকর্মী ও সহকর্মীরা এই মন্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
যোগী আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বহুল আলোচিত অভিযোগ হচ্ছে তার উসকানিমূলক ও মুসলিম বিরোধী বক্তব্য। ২০০৭ সালে গোরক্ষপুরে এক জনসভায় তিনি ঘোষণা দেন, ‘একজন হিন্দু মারা গেলে আমরা ১০০ মুসলমানকে হত্যা করব।’ এই বক্তব্যের ভিডিও ভারতীয় গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিন্দা জোটে।
এমনকি পরবর্তীতে তিনি মুসলিমদের ‘জেহাদি মানসিকতার অধিকারী’ বলেও আখ্যা দেন, যা আরো বেশি বিভাজনমূলক হয়ে ওঠে।
২০২০ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) বিরোধী বিক্ষোভ দমনে যোগীর প্রশাসন উত্তর প্রদেশে মুসলিমদের বাড়ি ঘরে অভিযান চালায় এবং বহু ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। বহু মুসলিম পরিবার দাবি করে, তারা বিনা নোটিশে ঘরছাড়া হয়, এমনকি প্রমাণ চাওয়ার পরও প্রশাসন কোনো কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হয়।
যোগী আদিত্যনাথের শাসনামলে উত্তর প্রদেশে ‘এনকাউন্টার সংস্কৃতি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮,৫০০টি পুলিশি এনকাউন্টার হয়, যার মধ্যে ১৬০ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও দলিত বেকার যুবক। বিরোধীরা একে ‘কাস্ট হান্টিং’ ও ‘মাইনরিটি ক্লিনসিং’-এর শামিল বলে অভিহিত করে। বিষয়টি নিয়ে ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (NHRC) তদন্তে নামে।
যোগী আদিত্যনাথ বাবরি মসজিদ বিষয়েও একাধিকবার উত্তেজনাকর মন্তব্য করেছেন। ২০১৯ সালে তিনি বলেন, বাবরি ভাঙা গর্বের বিষয়’ যা মুসলিম জনগোষ্ঠীর মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তীর মতো ধর্মীয় উৎসবকে অস্ত্র-মিছিল ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার মাধ্যমে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
শিক্ষাক্ষেত্রেও তার বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ আছে। তিনি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ও জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াকে ‘সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর’ হিসেবে বর্ণনা করেন, যা উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে মুসলিম ছাত্রদের প্রতি সন্দেহ ও নজরদারি বাড়িয়ে তোলে। এমন বক্তব্যের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে।
যোগীর শাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সমালোচনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ধর্মীয় স্বাধীনতা পর্যবেক্ষণ সংস্থা ইউএসসিআইআরএফ একাধিক প্রতিবেদনে যোগী সরকারের অধীনে ধর্মীয় নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদও উত্তর প্রদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সেই যোগীকে আধ্যাত্মিক আখ্যায়িত দিয়ে রোববার রাতে কুশলবরণ চক্রবর্তী ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘আমার সাথে বিজেপির যোগী আদিত্যনাথের দেখা হয়নি; আমার সাথে দেখা হয়েছে সনাতন ধর্মের নাথ সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা এবং গোরক্ষনাথ মঠের মঠাধীশ যোগী আদিত্যনাথের সাথে উত্তর প্রদেশের প্রশাসনিক প্রধানের সাথে। তার রাজনৈতিক দর্শন কী, সেটা আমার বিষয় নয়।’
তিনি বলেন, ২০২১ সালের মার্চ মাসে ভারতের গোরক্ষপুরে আয়োজিত ‘গ্লোবাল কন্ট্রিবিউশন অব নাথ পন্থ’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে বাংলাদেশে নাথ সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন তিনি। সম্মেলনের প্রথম দিনেই মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ তা উদ্বোধন করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আহসান হাবিব বলেন, একজন সাম্প্রদায়িক উসকানিদাতাকে আধ্যাত্মিক নেতা বলা নিন্দনীয়। সামাজিক মাধ্যমে এক শিক্ষার্থী লেখেন, একজন শিক্ষক যখন একজন মুসলিমবিদ্বেষী নেতার প্রশংসা করেন, তখন তিনি নিজেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ্যাকাডেমিক সফর থাকতেই পারে। কিন্তু একজন শিক্ষক যখন একজন সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকের আধ্যাত্মিকতা তুলে ধরেন, তখন তা একধরনের নরম সমর্থন বলেই গণ্য হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা তাহসান হাবিব বলেন, কুশল বরণ একাধিক আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বলেছেন, বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ ও পাহাড়িদের ওপর পরিকল্পিত গণহত্যা চলছে। ঢাকায় এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তা নেই এবং এ রাষ্ট্র ইসলামিক মৌলবাদীদের দ্বারা পরিচালিত।
‘জুলাই আগস্টে তিনি পোস্ট করেন, যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করছে তারা নাকি রাজাকারের বাচ্চা।’ বলেন তিনি।